সাইকেলে চড়ে রাতের ঢাকা ভ্রমণ

4 months ago 49

আবু সুফিয়ান সরকার শুভ

‘এই শহর, যাদুর শহর, প্রাণের শহর ঢাকারে’ গানের শব্দের মধ্যে যেন ঢাকা শহরের এক গভীর মায়া বিদ্যমান। এ শহর যেমন মায়ার, আনন্দে ডানা মেলে উড়াল দেওয়ার ঠিক তেমনই এর বিপরীতে এ শহরে আছে অনেক দুঃখের গল্পও।

দিনের কর্মব্যস্ত এই শহর রাত হলে অনেকটাই অচেনা হয়ে যায়। আর তাই তো সারারাত ঘুরে ঢাকা শহর দেখার ইচ্ছে অনেকদিন আগে থেকেই সুযোগ হয়ে উঠতো না। ট্যুর বা ঘোরাঘুরি সাধারণত প্ল্যান করে সময়মাফিক হয় না তবে এবার হয়ে উঠেছিল।

সন্ধ্যা থেকে সব রেডি করে একেবারে সাইকেল সাজিয়ে রাত প্রায় ১২ টার পর আমাদের যাত্রা শুরু হলো। শিপন, মিল্লাত, মাসুদ, মাহামুদ ও আমি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গেটে সাইকেল সাজিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু।

প্রথমে আমাদের গন্তব্য হাতিরঝিল। পিচঢালা পথ বেয়ে আনন্দ নিয়ে আমরা ছুটছি। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। ঢাকা শহরে যে যানজটমুক্ত চলাফেরা করা যায়, তা রাতে বের হলেই বোঝা যায়।

পথ চলতে চলতে আমরা বিভিন্ন কিছুই দেখছিলাম আর ভেবে আলোচনা করছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করা, কিন্তু পথের করুণ কাহিনিগুলো এড়াতে পাড়ছিলাম না। আমাদের সাইকেল বিরতি একদম হাতিরঝিলে।

রাতের নিয়নের আলো পানিতে পড়ে এক অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতিফলন ঘটছে। হালকা নীল আলোয় আমাদের সবার চেহারার মাঝে এক জ্বলজ্বলভাব এসে গেছে। মুখের ঘামগুলো যেন নীল আলোয় হিরকের মতো আলো ছড়াচ্ছে।

ছবি তোলার সময় খেয়াল করে দেখলাম রাতে রাস্তা দিয়ে কিছু ছেলে হাঁটছে। পড়নে হালকা নোংরা জামা, মাথায় স্টাইলিশ কাটিং দেখে ধারণা হলো রাস্তার পাশে টোকাই ছেলেপেলে হবে।

সবার একই কথা ফোন সাবধানে রাখিস। কারণ এরা ফোন ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দিতে পারে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলেও তরুণ বয়সের টোকাই ছেলেরা ঘুমায় না। এরা সারারাত ঘুরে বেড়ায়। হয়তো চুরি কিংবা ছোটখাটো সন্ত্রাসীমূলক কার্যক্রমে যুক্ত থাকে।

আরও পড়ুন

হাতিরঝিলে চারপাশে ঘোরা শুরু হলো। সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মনের আনন্দে গান গেয়ে যাচ্ছিলাম। একটু দূরে যেতে আশপাশে কিছু পাগলের দেখা মিললো।

হঠাৎ আমাদের মনে প্রশ্ন আসলো গুলিস্তানের ওই চিপাচাপায় পাগলরা না থেকে এই খোলামেলা পরিবেশে তো তারা থাকতে পারতো। এখানে আসেনা কেন? প্রশ্নের উত্তর অজানাই রয়ে গেল। ঝিলের ধারে পাগলের সংখ্যা নেহাত কম ছিলো। হাতে গোনা কয়েকজন।

গুলশানে বড় বড় দালানকোঠা পাড়ি দিতে গিয়ে মনে হলো কোনো এক ভিন্নদেশে অবস্থান করছি। আলিশান সব দালানকোঠা। সেই গভীর রাতে একদল শ্রমিক অনেক উঁচুতে সেই আলিশান বাড়ি নির্মাণে ব্যস্ত ছিলো। তাদের ঘুম নেই। টাকার কাছে তাদের ঘুমের আনন্দ বিক্রি।

সাইকেল নিয়ে ছুটছি। সবচেয়ে মজার দৃশ্য ছিল রাস্তার পাশে উন্মুক্ত পরিবেশে মা ও ছোট্ট শিশুটা ঘুমাচ্ছে। তাদের কোনো ভয় নেই। কোনো চিন্তা নেই, কি আনন্দের ঘুম! ছোট্ট শিশু মায়ের পাশের। মা ঘুমের মাঝেও আগলে রেখেছে তার সন্তানকে। এজন্য হয়তো বলে মায়ের কোলের মত নিরাপদ স্থান এ পৃথিবীতে আর নাই।

একটু দূরে যেতেই চোখে পড়লো রিকশার উপরই ঘুমাচ্ছেন কয়েকজন রিকশাচালক। তাদের ভয় রিকশা হারানোর। কেউ কেউ রিকশায় তালা দিয়ে কিংবা তালা ছাড়াই রিকশার সিটের ওপর শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। তাদের এ ঘুমে দেখে মনে হলো তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।

আমরা চলছি। সংসদ ভবনের সামনে এসে আমরা স্থির হলাম। এসেই চোখে পড়লো বেশ কিছু দম্পতিকে। তারাও রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে এসেছেন হয়তো। একটু বিশ্রাম সেরে চন্দ্রিমা উদ্যানের রাস্তার দিকে গেলাম। রাস্তায় পাহারত আছেন পুলিশ। তাদেরও কোনো ঘুম নেই।

আমরা রাস্তার পাশে বসলাম। গলা ছেড়ে একটু গান গাইলাম। রাস্তার লাইটের পাশে গভীর রাতে গান গেয়ে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে সুন্দর একটা মুহূর্ত উপভোগ করলাম।

রাত প্রায় ৩টা বেজে গেছে। সাইকেল চালিয়ে মোটামুটি সবাই ক্লান্ত। আমাদের রবীন্দ্র সরোবরে যাওয়ার কথা আর হলো না। আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হলাম।

উদ্যানে ঢুকে একটু বসতেই ফজরের আজান হয়ে গেল। দেখি উদ্যান তখনো গমগম করছে। কেউ বা গান গাইছে। কেউ বা গল্প করছে। ছেলে মেয়েরা সবাই একসঙ্গে আড্ডা জমাচ্ছে।

ক্লান্ত পথে উদ্যানের বেঞ্চের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। জোৎস্না নেই। সত্যিই এ শহর কখনো ঘুমায় না। কেউ না কেউ জেগে থাকে।

কেউ আনন্দে রাত জাগে কেউবা স্মৃতি নিয়ে কিংবা কেউ টাকার কাছে বিক্রি করে দেয় এত সুন্দর রাতটি। রাত সুন্দর আবার কারও কারও কাছে ভয়াবহও বটে!

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

জেএমএস/এমএস

Read Entire Article