নাসিরউদ্দিন ফুরকান
মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর তাগিদে। ক্ষুদেবার্তা ও মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে সারাবিশ্বে কয়েক বছরে জনপ্রিয় হয়েছিল খুব দ্রুত। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ফেসবুকে ভিডিওতে মনিটাইজেশন চালু করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। তার আগে ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল নামে একটি প্রোগ্রাম ছিল।যেখানে ফেসবুকের পাতায় খবর ও বিভিন্ন লেখার ওয়েবলিংক জেনারেট করে তা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো।নিউজফিডে আসা বিজ্ঞাপন থেকে বাংলাদেশের শতাধিক পারলিশার্স উপার্জন করতো আর্টিকেল দিয়ে।
সেই সময় ফেসবুক একটি স্ট্যান্ডার্ড ফলো করতো। ইউটিউবের আদলে ফেসবুক ভিডিও থেকে উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করলে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা ফেসবুকে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এই তালিকায় যোগ হয় বিশ্বের সেরা টেলিভিশন, রেডিও ও নিউজপেপার। এই গণমাধ্যমে নিউজ, স্পোর্টস, এন্টারটেইনমেন্টের জন্য আলাদা আলাদা অসংখ্য ফেসবুক পেজ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও মানুষ অনেক পেজে নিজেদের তৈরি কনটেন্ট দেন।
আমি নিজে ২০১৮ সাল থেকে ফেসবুক থেকে উপার্জন করে আসছি। প্রথমে ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল এরপর ফিচার ভিডিও থেকে উপার্জনের সুযোগ পাই। ২০২০ সাল থেকে ভিডিও থেকে উপার্জন করে এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছি। তবে আমি ইদানীং কাজে উৎসাহ পাওয়ার চেয়ে বেশি নিরুৎসাহিত হচ্ছি ফেসবুকের বর্তমান কনটেন্ট দেখে। ফেসবুক যেমন ইউটিউব, টিকটকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের প্রোগ্রাম পরিবর্তন করেছে একইভাবে গণমাধ্যমের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। কে কত ভিউ পেলো আর দর্শকের সাড়া পেলো তার প্রতিযোগিতা এখন প্রকাশ্যে। ব্যক্তিগতভাবে যারা ভাইরাল হচ্ছেন তারা বড় একটি শ্রেণির কাছে তারকা বনে যাচ্ছেন।
মাদকের চেয়ে বড় মাদকতা সৃষ্টিতে অনন্য ফেসবুক। আমি আমার ছোট বাচ্চার সামনে কিংবা গণপরিবহনে চলার সময় ফেসবুকের নিউজফিড দেখার সাহস পাই না। কখন কী এসে পড়ে আমি তো জানিই না স্বয়ং ফেসবুকও জানে না। ডলারের নেশায় ব্যক্তিগত আইডি এখন মনিটাইজ করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ফেসবুকে এসে লাইভ শেয়ার দিতে বলে। পাশে থাকলে পাশে পাবেন, স্টার দিন, ফলো টু ফলো ব্যাক নানা রকম আকুতি-মিনতি ফেসবুকে।
ব্যক্তিগত আইডি মনিটাইজ দেওয়ার পর অনেকেই ভিডিও দিচ্ছেন। কী দিচ্ছেন সেটা আপনারা দেখছেন প্রতিদিন। অমুক ইনকাম করে, তমুক ইনকাম করে; আমিও ইনকাম করবো- এই চিন্তা থেকেই এই ভিডিওর উদ্ভব। ফেসবুক ইউটিউব-টিকটকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের একটি প্রতিযোগিতায় ফেলে দিয়েছে। নিউজফিডে ভালো কনটেন্টের চেয়ে অপ্রাসঙ্গিক ও অশ্লীল ভিডিও বেশি আসছে।
আমি নিজে ফেসবুক থেকে উপার্জনের টাকায় ভালো আছি, এরপরও আমার মনে হয় ভিডিও থেকে ইনকামের উপায় ফেসবুক বন্ধ করে আগের প্রোগ্রামে ফিরে গেলে ভালো হতো। কেন বলছি এই কথা! আপনি খেয়াল করলে দেখবেন দেশের পত্রিকা, টেলিভিশন সাংবাদিকতার নামেও ভিউ প্রতিযোগিতা চলছে। যার ভিডিও যত ভিউ তার আনন্দ তত বেশি। পত্রিকার মোজো সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা এই ভিউ থেকেই বেশির ভাগ আসে। তাই কেউ ভাইরাল হতে আসে, কেউ ভাইরাল করতে যায়- এমন চলছে অনেক গণমাধ্যম।
মার্ক জাকারবার্গ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের এই জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমে এখন বাংলাদেশের প্রায় ছয় কোটি মানুষের আনাগোনা। তাই ভিডিও দিলে ভিউ হচ্ছে উপার্জন হচ্ছে। যে যা পারে না বলতে, যে যা পারে না করতে; সেও তাই-ই করার চেষ্টা করছে। অসুস্থ আর বিকারগস্ত হয়ে যাচ্ছে নেটিজেনরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন অসামাজিক মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন জাগে, আমরা কবে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসামাজিক হলাম কিংবা আয়-রোজগার দিয়ে সামাজিক মাধ্যম অসামাজিক করছে আমাদের! এটা থেকে উত্তরণের উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। না হলে পরবর্তী প্রজন্মের মেধা, মননের উৎকর্ষসাধন বাধাগ্রস্ত হবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্পেশালিস্ট
বিএ/জেআইএম