সার আমদানি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ভিত্তিহীন: কৃষি মন্ত্রণালয়

6 hours ago 2

দেশে যখন সারের সংকট চলছে, ঠিক সে সময় এক ব্যক্তির একাধিক কোম্পানিকে সার আমদানিতে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ওই অসাধু কার্যক্রমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এ অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছে মন্ত্রণালয়।

বিষয়টি অস্বীকার করে শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

অভিযোগ রয়েছে, সরকারি অর্থ লোপাটের এক ধরনের অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। বেসরকারি মাধ্যমে সার আমদানি করতে মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা যোগসাজশ আমদানি দরপত্র বিপরীতে মনগড়া নিয়মে একক ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়। সে ক্ষেত্রে দরপত্র নিয়মনীতি উপেক্ষা করা হয়েছে।

সার আমদানি সংক্রান্ত পরিপত্র অনুযায়ী প্রাপ্ত দরের মধ্যে সর্ব নিম্ন দরের ক্রমানুসারে কার্যাদেশ দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু তা অমান্য করে দরপত্র প্রাপ্ত দরের বাইরে ‘নেগোসিয়েশন’ এর মাধ্যমে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। যে কারণে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পায়নি।

এদিকে, এসব নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার পরিপেক্ষিতে গণমাধ্যমে একটি ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। যেখানে ‘সার আমদানিতে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানান, সরকার যে প্রক্রিয়ায় কার্যাদেশ দিয়েছে তাতে প্রতিটি কার্যাদেশের বিপরীতে টনপ্রতি ২০-১৫০ ডলার পর্যন্ত সরকার ব্যয় কমিয়ে আনতে পেরেছে। আমদানি নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে। অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও দৈনিক পত্রিকায় ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ে সরকারি অর্থ লোপাটের অভিনব উদ্যোগ’ বা ‘সার আমদানিতে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ’ প্রভৃতি শিরোনামে প্রকাশিত পোস্ট/ প্রতিবেদনগুলোর প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো মতামত/সংবাদের বিষয়বস্তু ভিত্তিহীন, মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অসত্য তথ্য সম্বলিত। প্রকাশিত পোস্ট/ প্রতিবেদনগুলো ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার বলে মন্ত্রণালয়ের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে এবং মন্ত্রণালয় প্রকাশিত পোস্ট/ প্রতিবেদনগুলোর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

এ পদ্ধতি অনুসরণ করে নন-ইউরিয়া সারের আমদানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওই পদ্ধতিতে প্রতি ধাপের টেন্ডারে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমাণ (কম বেশী ৩০,০০০ মে.টন) সারের জন্য দরপ্রস্তাব দাখিল করতে হয়। সরকারের সার-ভিত্তিক আমদানি চাহিদা ওই সিলিংয়ের চেয়ে অনেক বেশী হওয়ায় ওই পদ্ধতি অনুযায়ী দর প্রস্তাবে অংশগ্রহণকারীরা একই দেশের একই সারের জন্য দাখিল করা দরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন দরের পাশাপাশি দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রভৃতি দরদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে টনপ্রতি ২০ মার্কিন ডলার থেকে ১৫০ মার্কিন ডলার বা তারও বেশী ব্যবধানে সার সরবরাহের সুযোগ তৈরি হতো।

এতে সরকার বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটতো। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর, নির্দিষ্ট সারের জন্য নির্দিষ্ট দেশের আমদানিকারকরা প্রদত্ত সমুদয় দরের মধ্যে কেবল সর্বনিম্ন দরে সার সরবরাহে সম্মতি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রয়াদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং গত অর্থবছর থেকেই তা কার্যকর করা হয়। ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হয় এবং আমদানিকারকদেরও অসম লাভের পথ সংকুচিত হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ জুলাই সাড়ে ৯ লাখ টন সার আমদানি একটি টেন্ডার আহ্বান করে মন্ত্রণালয়। এ টেন্ডারের মাধ্যমে ৫ লাখ ১৫ লাখ টন টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি আমদানি কার্যাদেশ দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। বাকি ৪ লাখ ৩৫ হাজার টনের আমদানি জন্য পুনরায় টেন্ডার করা হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এই ৫ লাখ ১৫ হাজার মে টন নন ইউরিয়া সার আমদানি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে মোট ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান এবং ওই ব্যক্তির আত্মীয়র এক প্রতিষ্ঠানের নামেই মোট ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন সার আমদানি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যক্তিকে যে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে সেখানেও বিশেষ সুবিধা দিতে দেখা গেছে।

জানা গেছে, বড় কার্যাদেশ পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান হলো দেশ ট্রেডিং করপোরেশন এবং বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। দুটি কোম্পানির স্বত্বাধিকারী হলেন আমিনুর রশিদ খান। অন্য একটি কোম্পানি হলো এনআরকে হোল্ডিং যার স্বত্বাধিকারী নায়েব রশিদ খান। নায়েব রশিদ খান আবার আমিনুর রশিদ খানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে পরিচিত। এ প্রতিষ্ঠানের নামে কার্যাদেশটি আমিনুর রশিদ খানই নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

২০২৪ জুলাইয়ে পট পরিবর্তনের পর থেকেই মামুন কৃষি মন্ত্রণালয়ের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে এসব প্রতিষ্ঠানের নামে।

জানা গেছে, নির্দিষ্ট দেশ থেকে সার আমদানি জন্য ভিন্ন ভিন্ন দর অনুমোদন করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। একই কার্যাদেশে দুটি দেশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দর দিলেও পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে একসঙ্গে। যে দেশের সারের দাম বেশি সেখান থেকে পরিমাণে কম এনে যে দেশে দাম কম সেখান থেকে বেশি দামের সার আনার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, যে সুবিধাটা বাকি ১৮ আমদানিকারকের কাউকেই দেওয়া হয়নি।

বাকি আমদানিকারকদের অবশ্য নিয়মানুযায়ী একটি লটের বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট দামে একক দেশের অনুকূলেই সার আমদানি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশ ট্রেডিং করপোরেশনের নামে একটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার মে টন টিএসপি সার আমদানি জন্য। এ ৩০ হাজার টনের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে দুটি দেশের দর অনুমোদন করা হয়েছে। মরক্কো থেকে ৬৯৪ মার্কিন ডলার এবং লেবানন থেকে ৬৮৮ মার্কিন ডলার। কিন্তু কোন দেশ থেকে কতটুকু আমদানি করবে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। এই ধরনের কার্যাদেশ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেও জানা গেছে।

একইভাবে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ৪০ হাজার টন ডিএপি সার আমদানি একটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ সার একই সঙ্গে দুটি দেশ থেকে আমদানি অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ৮৭৪ মার্কিন ডলারে মিশর থেকে এবং ৮৪৮ ডলারে চীন থেকে আমদানি অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

দেশের সব খাতে আওয়ামী লীগ আমলে তৈরি হওয়া সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে দেখা গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ও এই ধারাবাহিকতায় সার আমদানিতে সিন্ডিকেট ভাঙার কথা বললেও এক ব্যক্তিকে যে পরিমাণ সার আমদানি কার্যাদেশ দিয়েছে তাতে নতুন করে সিন্ডিকেট তৈরির অভিযোগ উঠেছে। অথচ ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন সার আমদানি যে কার্যাদেশ মামুনের অনুকূলে দেওয়া হয়েছে তা আমদানি সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

যে কারণে নির্দিষ্ট সময়ে যদি প্রতিষ্ঠানটি সার আমদানি করতে না পারে তাহলে আসন্ন পিক সিজনে সারের ঘাটতি তৈরিতে এর প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা রয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং সেলের একাধিক কর্মকর্তা মামুনকে বড় পরিসরে সার আমদানি কার্যাদেশ পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন।

প্রসঙ্গত, বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল শুধু নন ইউরিয়া নয়, ইউরিয়া সার পরিবহনের জন্যও বিসিআইসির তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরিবহন ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে সার আত্মসাতের অভিযোগ উঠে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের তদন্তে সার আত্মসাতে যে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নাম আসে তার মধ্যে একটি ছিল আমিনুর রশিদ খান মামুনের বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ভর্তুকির আওতায় বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে ২ লাখ মেট্রিক টন টিএসপি, ৫ লাখ মেট্রিক টন ডিএপি, ২ লাখ ৫০ পক্ষ মেট্রিক টন এমওপি এবং শূন্য দশমিক ২০ লক্ষ মেট্রিক টন এমএপি সার সংগ্রহের জন্য প্রথম টেন্ডার আহ্বান করে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর বিপরীতে ৪৯টি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাবে অংশ নেয়। কিন্তু যারা এ দরপ্রস্তাবে অংশ নেন তাদের সর্বনিম্ন দর এখানে গ্রহণ করেনি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় অংশগ্রহণকারীদের দেশভিত্তিক এক দরপ্রস্তাব করে। এ প্রস্তাবে রাজি হতে আমদানিকারকদের মৌখিকভাবে অনুরোধ করে।

এ অনুরোধে যারা যারা কৃষি মন্ত্রণালয়ের দরপ্রস্তাবে রাজি হয় তারা সম্মতিপত্রের চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়কে। এ সম্মতিপত্রেও ভুল দর উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল, নির্দিষ্ট দেশ ভিত্তিক নির্ধারিত দর উল্লেখ করে এ সম্মতিপত্র দেওয়ার কথা। তবে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল টিএসপি আমদানি জন্য ৭০৪ ডলার দাম উল্লেখ সব অরিজিনের জন্য (দেশভিত্তিক) চিঠি দেয়। অথচ ৭০৪ ডলার দর নির্ধারণ করা ছিল শুধু তিউনেশিয়ার জন্য। মরক্কোর জন্য ছিল ৬৯৪ ডলার, লেবানন ও মিশরের জন্য ৬৮৮ ডলার করে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। অথচ বাল্ক ট্রেড যে টিএসপি আমদানি যে দুটি কার্যাদেশ পেয়েছে সেগুলো মরক্কো এবং লেবানন থেকে আমদানি জন্য।

আবার প্রতিষ্ঠানটি এ সম্মতিপত্রের সঙ্গে নিয়মানুযায়ী কোন ম্যানুফ্যাকচারার্স সার্টিফিকেট সংযুক্ত করেনি। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় এ প্রতিষ্ঠানকে নতুন সম্মতিপত্র দেওয়ার জন্য সুযোগ দেয়। অথচ অনেক আমদানিকারক ঠিকঠাক সম্মতিপত্র দিয়েও টিএসপি আমদানি কার্যাদেশ পায়নি।

আমদানিকররা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার বিশেষ বিবেচনায় এ কাজ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা তাকে কার্যাদেশ দিতে চেয়েছেন তাই সুবিধা দিয়েছেন। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সার আমদানি জন্য দুটি দেশের মূল্য উল্লেখ করে কার্যাদেশ দেওয়ার কোনো নজির নেই।

ওদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘নির্দিষ্ট কোনো সারের ক্ষেত্রে একটি দেশের বেলায় সকল আমদানিকারককে কেবল একটি নির্দিষ্ট দরেই সার সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন দরে নয়।’ মন্ত্রণালয় এই দাবি করলেও বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, দেশ ট্রেডিং করপোরেশন ও এনআরকে গ্লোবালের কার্যাদেশে তা মানা হয়নি।

এনএইচ/এমএএইচ/জেআইএম

Read Entire Article