অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলার সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত হতে পারেনি সারের বাজার। পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলাররা অবৈধভাবে সার মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এতে অতিরিক্ত দামে সার কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। এ অবস্থায় কৃষি উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ প্রয়াস নষ্টসহ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এক হাজার ৫০ টাকার ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা ডিএপি সার এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি ও পর্যাপ্ত সার না পাওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা ক্ষুব্ধ।
প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বার্ষিক সারের চাহিদা তিনটি মৌসুমে ভাগ করা হয়। সবচেয়ে বেশি সার প্রয়োজন হয় রবি মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চে (কার্তিক-ফাল্গুন)। এ সময় মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ সার প্রয়োজন হয়। পরবর্তী মৌসুম আউশ, যা এপ্রিল থেকে জুলাই (চৈত্র-আষাঢ়) পর্যন্ত। এ সময় চাহিদার ৩০ শতাংশ এবং আমন মৌসুমে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর (আশ্বিন-মাঘ) অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ সারের প্রয়োজন হয়। দেশের প্রতিটি জেলায় মৌসুমের চাহিদা অনুযায়ী সার ডিলারের কাছে বিতরণ করা হলেও পরিবহন ব্যবসায়ী ও ডিলাররা সিন্ডিকেট করে দেশে সারের সরবরাহে কৃত্রিম ঘাটতি দেখিয়ে বিক্রির সময় কৃষকদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে।
এই পরিস্থিতিতে আসন্ন মৌসুমেও (নভেম্বর-মার্চ) সারের সরবরাহ ও দাম নিয়ে সংকট তৈরির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ডিলাররা সিন্ডিকেট করে সার গুদাম থেকে না তুলে সরবরাহ ঘাটতি তৈরি করছেন।
- আরও পড়ুন
উত্তরে সারের ‘কৃত্রিম সংকট’, বিপাকে কৃষক
পাবনায় সারের ‘কৃত্রিম সংকট’, বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ৭০০-৮০০ টাকা
সার সংকট জাদুঘরে পাঠানো হবে: কৃষিসচিব
এ বছর সারা দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা রয়েছে ৫৭ লাখ ৮৫ হাজার টন। এ চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সরকারিভাবে আমদানি করা হচ্ছে। বাকি ২০ শতাংশ সার দেশের সার কারখানার উৎপাদন থেকে মেটানো হয়। এসব সারের সরবরাহ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। দুটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বা আমদানি পরবর্তী মজুত ও সরবরাহ নিশ্চিত করে তাদের নিয়োগ করা পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলারদের মাধ্যমে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিলাররা সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সার তাদের নিজস্ব গুদামে মজুত করেন। সেখান থেকে কৃষকদের কাছে সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করেন। কিন্তু কিছু অধিক মুনাফালোভী ডিলার কারসাজির মাধ্যমে গোপনে সার মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কৃষকদের কাছে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করে থাকেন।
বর্তমানে বিভিন্ন গুদামে ছয় লাখ ৩০ হাজার ৬১৩ টন ইউরিয়া সারের মজুত রয়েছে। এছাড়া দুই লাখ ১৭ হাজার টন টিএসপি, দুই লাখ ৭৩ হাজার টন ডিএপি এবং দুই লাখ ৮১ হাজার টন এমওপি সার মজুত রয়েছে। এই সার দিয়ে তিন মাসের সারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
বিএডিসির তথ্য বলছে, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সারা দেশে জুলাই মাসের চাহিদা অনুযায়ী সার ডিলারদের কাছে সরবরাহ করার পরও বর্তমানে বিভিন্ন গুদামে ছয় লাখ ৩০ হাজার ৬১৩ টন ইউরিয়া সারের মজুত রয়েছে। এছাড়া দুই লাখ ১৭ হাজার টন টিএসপি, দুই লাখ ৭৩ হাজার টন ডিএপি এবং দুই লাখ ৮১ হাজার টন এমওপি সার মজুত রয়েছে। এই সার দিয়ে তিন মাসের সারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। পাশাপাশি ২৫ হাজার টন টিএসপি, এক লাখ ১০ হাজার টন এমওপি এবং এক লাখ ২০ হাজার টন ডিএপি জাহাজে রয়েছে, যা দেশে পৌঁছাবে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএডিসি ও বিসিআইসির হিসাব অনুযায়ী দেশে সারের কোনো সংকট না হওয়ার কথা থাকলেও কিছু কিছু জেলার অসাধু ডিলার ও পরিবহন সংস্থার সিন্ডিকেটে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির ফলে সারের দাম বেড়েছে।
সার আমদানি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ছয় থেকে আট মাস সময় লাগে। আমদানির বেশির ভাগ সার নৌপথে আসে। সার খালাস করতে অনেক সময় লাগে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা জাহাজ থেকে সার খালাসে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি সময় ব্যয় করে। এতে বাজারে সারের সংকট সৃষ্টি হয় এবং মূল্য বৃদ্ধি পায়।
পাশাপাশি গুদামেও সার দেরিতে পৌঁছানোর মাধ্যমে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সরবরাহ পর্যায়ে অনেক ডিলার নিয়মিত সার উত্তোলন করছেন না।
- আরও পড়ুন
সারের সরবরাহ কমতে দেবো না: অর্থ উপদেষ্টা
পর্যাপ্ত সার মজুত আছে, আমনে সংকট হবে না: কৃষি মন্ত্রণালয়
গাইবান্ধায় সার সংকট, শঙ্কায় চাষিরা
বিএডিসি ও বিসিআইসি দুটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমানে সাত হাজার ১৫০ জন ডিলার রয়েছেন। এর মধ্যে বিএডিসি অনুমোদিত পাঁচ হাজার ২২ জন এবং বিসিআইসির দুই হাজার ১২৮ জন। যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া। এমন অনেক ডিলার রয়েছেন যারা একই ব্যক্তি, ভিন্ন ভিন্ন নামে একাধিক ডিলারশিপ নিয়ে এ খাতকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন।
যারা অনিয়মে জড়িত এবং অতীতে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের সবার ডিলার লাইসেন্স বাতিল হবে। প্রয়োজনে আইনের আওতায় আনা হবে। - অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সাল ইমাম
সার ডিলার নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন
প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ উইংয়ের প্রধান অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সাল ইমাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরে আমরা সার ডিলার নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করছি। আমরা দেখছি অতীতে কারা অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন, কারা অনিয়ম করছেন। তাদের বিষয়ে আমরা মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করছি। এরই মধ্যে অনেক তথ্য পেয়েছি।’
তিনি বলেন, যারা অনিয়মে জড়িত ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছে, তাদের সবার ডিলার লাইসেন্স বাতিল হবে। প্রয়োজনে আইনের আওতায় আনা হবে।
‘বাধ্য হয়ে বেশি দামে সার কিনতে হয়েছে’
সার সংকট নিয়ে কৃষকরাও দুষছেন ডিলারদের। কৃষকদের অভিযোগ, সরকারি অনুমোদিত ডিলারদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে সার না পেয়ে তারা বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দাম দিয়ে খুচরা দোকান থেকে সার সংগ্রহ করছেন। তাদের মতে, একটি সংগঠিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পীরপুর গ্রামের চাষি মিনারুল ইসলাম বলেন, ‘ডিলারের কাছে কার্ড দেখালে বিঘাপ্রতি মাত্র ১০ কেজি সার দিচ্ছে। আমার ছয় বিঘা জমির জন্য দরকার ১৮০ কেজি সার, অথচ পেয়েছি মাত্র ৬০ কেজি। বাধ্য হয়ে বাজার থেকে বেশি দামে সার কিনতে হয়েছে।’
প্রতি মৌসুমে একই সমস্যা। সময় মতো সার না পেলে চাষ করবো কীভাবে? এটা পরিকল্পিত সংকট। সিন্ডিকেট ছাড়া সম্ভব নয়। - কৃষক আবুল কালাম আজাদ
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘প্রতি মৌসুমে একই সমস্যা। সময় মতো সার না পেলে চাষ করবো কীভাবে? এটা পরিকল্পিত সংকট। সিন্ডিকেট ছাড়া সম্ভব নয়।’
- আরও পড়ুন
সার মজুত করে সংকট তৈরি, জরিমানা ৩০ হাজার টাকা
এবার সার সংকটের শঙ্কা নেই
দেশে সারের সংকট নেই, অতিরিক্ত মজুত না করার আহ্বান উপদেষ্টার
যা বলছেন সার ব্যবসায়ী ও ডিলাররা
খুচরা সার ব্যবসায়ী আলমগীর হাসান বলেন, ‘কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে জেলার বাইরের উৎস থেকে সার এনে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণে দাম কিছুটা বাড়তি। এতে কৃষকদেরও বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে।’ এনামুল হক নামের এক বিসিআইসি ডিলার বলেন, ‘আমাদের চুয়াডাঙ্গায় সার সংকট নেই। তবে অনেক জায়গায় সংকট আছে শুনেছি। অনেক ডিলার ঠিকমতো সার উত্তোলন না করায় সরকারিভাবে মজুত বেশি থাকতে পারে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিসিআইসির ডিলার বলেন, ‘সার সরবরাহ কিছুটা কম, আবার সব কৃষক একসঙ্গে নিতে চাচ্ছেন। তাই সবাইকে কম করে দিতে হচ্ছে।’
আমার যিনি ডিলার তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির আত্মীয় ও নিজেও আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তিনি বেশি সার উত্তোলন করেন না। - ডিলারের ম্যানেজার
আরেক ডিলারের ম্যানেজার বলেন, ‘আমার যিনি ডিলার তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির আত্মীয় ও নিজেও আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তিনি বেশি সার উত্তোলন করেন না।’
- আরও পড়ুন
গাইবান্ধায় কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বাড়তি দামে সার বিক্রির অভিযোগ
কৃত্রিম সার সংকটে দিশেহারা চাষি
সারের ভর্তুকি নিয়ে উভয় সংকটে সরকার
সার সংকট নিরসনে যেসব সুপারিশ
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের শেষে ১২ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী সারের সরবরাহ নিশ্চিত করা; ডিলার ও পরিবহন কোম্পানির সিন্ডিকেট রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বৃদ্ধি করা, প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করা; একই ব্যক্তি যাতে ভিন্ন ভিন্ন নামে একাধিক ডিলারশিপ না পায় সে বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ডিলাররা সরকার নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে সার বিক্রি করতে না পারে সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা; ডিলার ও পরিবহন সংগঠন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদার ভেসেল থেকে সার খালাসে যাতে বিলম্ব সৃষ্টি করতে না পারে তার ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা; রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে ডিলার ও পরিবহন কোম্পানি নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া; যেসব জেলায় সারের চাহিদা বেশি থাকে সেসব জেলায় বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
এনএইচ/এমআরএম/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম