সুরাইয়া ইয়াসমিন সুমি
স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ হিসেবে বেছে নেওয়া হলো সৌন্দর্যের আধার সিলেটকে। পাহাড়, ঝরনায় এক অমলিন বহিঃপ্রকাশ। দিনটা ৩ সেপ্টেম্বর। সময় বিকেল সাড়ে ৫টা। সঙ্গে আমাদের সহপাঠী আর শিক্ষকরা। গাড়ি সবকিছুকে ফেলে সামনে ছুটে চলছে। উদ্দেশ্য সিলেটের অপরূপ পরিবেশ দর্শন। বিকেল গড়িয়ে প্রায় আলো ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। সবার মধ্যে এক প্রতীক্ষিত ভাবনা। সময় যেন বাঁধা মানে না।
সময় পেরিয়ে এলো সেই ক্ষণ। সকালের সুপ্ত আলোর উদীয়মান দীপ্তিতে সবুজের মধ্য দিয়ে পৌঁছে গেলাম সিলেট শহরে। আমরা সিলেট শহরের ভেতর আপন হোটেলকে আপনের মতো আপন করে নিলাম। সবাই ক্লান্ত, ম্যাম সবাইকে রুম দিয়ে দিলেন। সবাই ক্লান্তি ভাবটা কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। যেহেতু মাঠকর্মই কাজ; সেহেতু ম্যাম আমাদের তৈরি হতে বললেন। আমরাও তৈরি হয়ে গেলাম। আমরা বুঝিনি সারপ্রাইজ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
আমরা দূরে সবুজের মাঝে নীল আকাশের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের এক সৌন্দর্যের আধার দেখলাম। জাফলংয়ের দিকে গাড়ি ছুটে চলছে। সবাই খুশির সাথে সাথে অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। জাফলংয়ে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল মেঘালয় আর ছোট ছোট ঘর। যেটি ডাউকি সিটি নামে পরিচিত। আকাশ আর পাহাড় মিশে একাকার। সত্যি সৌন্দর্য অতুলনীয়।
এখানকার উপক্রান্তীয় পর্বত আর রেইনফরেস্টের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখার মতো। জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা শেষে মায়াবি ঝরনা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সহপাঠীদের জন্য। আমরা ১৩ জন জাফলংয়ের সিঁড়ি ভেঙে যত নিচে নামছিলাম; চারদিকে চোখে পড়ছিল হরেক রকম দোকান, চকলেট, কখনো মনিপুরী বাহারি পোশাক, কখনো আবার আচার। নৌকায় করে ওপারে যেতে জনপ্রতি ৮০ টাকার বদলে ৬০ টাকা নিলো। পানির স্নিগ্ধ শীতল ঠান্ডায় মন জুড়িয়ে গেল। ওপরে স্বচ্ছ পানি, যার জন্য নিচে পাথর অনেক সময় দেখা যাচ্ছে। রোদ ছিল তীব্র; তবুও পানি যেন শীতল পরশ মেখে গেছে।
মায়াবি ঝরনার দিকে যাওয়ার পথে মরুভূমির মতো বালি যেন চিকচিক করছে রোদের আলোয়। কাছে গিয়েই যেন প্রাণভরে গেল। আমার সহপাঠী ও আমিসহ সবাই ছবি তুললাম এ স্মৃতিকে ধরে রাখতে। ওপরে গিয়েছিল আমার দুই সহপাঠী ফুয়াদ আর রনি। দিনটি ফুরিয়ে যখন বিকেল হয়ে এলো; তখন শাহ পরাণ মাজার হয়ে নিজেদের কাজের জায়গায় গেলাম। ঘণ্টাখানেক কাজ করে ফিরে এলাম রুমে। দিনটি কেটে গেল।
আরও পড়ুন
পরদিন সকাল ৬টায় সবাই একত্রিত হলাম হোটেলের লবিতে। ম্যামের জন্য অপেক্ষা চাতক পাখির মতো। একপর্যায়ে ম্যাম বললেন দ্রুত কাজের জায়গায় যেতে। গেলাম আমরা যার যার জায়গায়। মাটি-কাদার সাথে যেন এক হয়ে কাজ করেছি সবাই। কাজ শেষে গেলাম পরিবেশের অপরূপ সৌন্দর্যের স্থান ভোলাগঞ্জ। এটি ঢালা নদীর তীরে অবস্থিত। ভোলাগঞ্জের ঢালা নদী দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি অঞ্চল।
এখান থেকে ছাতক পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ভোলাগঞ্জ রজ্জুপথ। এখানে যাওয়ার জন্য স্যার আমাদের নয়জন করে একটা দলে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন। স্বচ্ছ পানি আর সাদা পাথরে কম-বেশি সবাই একটু শীতলতা খুঁজে নিয়েছিলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা এ সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে গেলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৫ মিনিটের জন্য রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে এলাম রুমে।
দিনটি আমাদের সিলেট শহরের শেষদিন। সকাল সকাল সবাই বাসের আসন গ্রহণ করলাম। ফেরার সময় চলে এলো। আসলে কখনো কিছু স্থায়ী নয়। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে গাড়ি চলছে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের দিকে। ঝরনার রানির দেশ বলা হয় একে। এটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানে আছে ইকোপার্ক ও শিবমন্দির। পাহাড় থেকে নেমে আসা গঙ্গামারা প্রবাহের এক অপরূপ ধারা। প্রায় ১৮০ ফুট উঁচু টিলা থেকে অবিরাম ধারায় পতিত হচ্ছে পানির শব্দের ধারা। মনোমুগ্ধকর এক অনুভূতি।
যাওয়ার আছে আরও জায়গা। সীমিত সময় তাই দেরি না করে রওয়ানা দিলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দিকে। বাংলাদেশের ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অন্যতম। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ১ হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের এ বন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। আমাদের সুজয় স্যার গাইড করে নিয়ে গেলেন খাসিয়া পল্লিতে। প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম। আসলেই অন্যরকম অনুভূতি।
সেখান থেকে এসে গন্তব্য প্রায় শেষের পথে শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে নীলকণ্ঠে যাওয়ার পথে চোখে পড়লো রাবার বাগান। আমার অটো থামিয়ে একটু ছবি তুলে নিলাম। সময় বেশি নেই। সিলেটে এসেছি আর চা নিবো না, তাই কি হয়! সবাই যে যার মতো যা পারছি তাই নিয়েছি। সময় শেষ; ফিরতে হবে নীড়ে। বেশি দেরি না করে বাসে ফিরে এলাম। চলতে থাকলো আপন ঠিকানায়। ক্লান্তি, স্মৃতি আর মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এলাম। মনের ভেতর রয়ে গেছে সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট। সত্যি অন্যরকম এক অনুভূতি।
লেখক: অনার্স ৩য় বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।
এসইউ/এমএস