শিশুদের সীসা দূষণের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে ঢাকায় সীসা নির্গমনকারী শিল্প-কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।
বুধবার (৬ আগস্ট) রাজধানীতে ‘বাংলাদেশে সীসা দূষণ প্রতিরোধ: অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক বিশেষ আলোচনা সভায় বক্তারা এই আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে আইসিডিডিআর,বি-এর হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর ড. সারাহ স্যালওয়ে বলেন, সীসা দূষণ বাংলাদেশের অন্যতম মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হলেও তা বহু ক্ষেত্রেই অবহেলিত। বিশেষ করে কারখানার আশপাশের দরিদ্র শিশুদের জীবন সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সীসা এক ধরনের বিষাক্ত ভারী ধাতু যা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করে, আইকিউ কমায় এবং শেখার ক্ষমতায় স্থায়ী প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি শিশুদের রক্তে প্রতি লিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সীসার উপস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করে। অথচ বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু রক্তে উচ্চমাত্রার সীসা নিয়ে জীবনযাপন করছে, যা ইউনিসেফ-এর মতে, বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ।
সভায় আইসিডিডিআর, বি ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একাধিক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। ২০০৯–২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বস্তি এলাকার ৮৭ শতাংশ শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা ছিল প্রতি লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি। আর ২০২২–২০২৪ সালে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ২–৪ বছর বয়সী ৫০০ শিশুর প্রত্যেকের রক্তেই সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যেখানে মধ্যমমাত্রা ছিল ৬৭ মাইক্রোগ্রাম/লিটার। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে মাত্রা ছিল সিডিসি নির্ধারিত ঝুঁকির সীমা অতিক্রম করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু সীসা-নির্ভর শিল্প স্থাপনার ১ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে, তাদের রক্তে সীসার মাত্রা অন্যদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি।
প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে, লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি তৈরির বা রিসাইক্লিং কারখানা, সীসাযুক্ত রং ও প্রসাধনী, রান্নার ভেজাল হলুদের মতো খাদ্যদ্রব্য, ঘরোয়া ধূমপান ও দূষিত ধূলিকণা।
আইসিডিডিআর,বি-র প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ডা. মো. মাহবুবুর রহমান জানান, রান্নায় ব্যবহৃত হলুদে সীসাযুক্ত লেড ক্রোমেট মিশ্রণের বিষয়টি চিহ্নিত করার পর ২০১৯ সালে যেখানে ৪৭ শতাংশ নমুনায় সীসা পাওয়া যেত, তা কমে ২০২১ সালে শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে। এই সাফল্য এসেছে সরকারি নজরদারি ও আইন প্রয়োগের ফলে।
আইসিডিডিআর,বি-র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, সীসা নীরবে শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে। এটি তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করে, দেহে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি করে এবং জাতির ভবিষ্যৎকে পিছিয়ে দেয়। তাই আমাদের এখনই সীসা নির্গমণকারী উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সভায় অংশগ্রহণকারী গবেষক ও সাংবাদিকরা শিশুদের সুরক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। আইসিডিডিআর,বি এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা একমত হন যে, সীসা দূষণের মূল উৎস নিয়ন্ত্রণেই হতে পারে শিশুদের নিরাপদ ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ।
আলোচনা সভাটি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়, যেন বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠতে পারে একটি সুস্থ, নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় পরিবেশে।
এসইউজে/এসএনআর/এএসএম