সুন্দর ও সুখী বাংলাদেশ!

2 hours ago 4

শীতের জরাজীর্ণতাকে  সরিয়ে অপরূপ রূপে প্রকৃতিতে আসবে বসন্ত। এই ঋতুরাজ বসন্তের মতো একটি সুন্দর ও সুখী দেশ দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে বাংলাদেশর জনগণ। একটি সুন্দর ও সুখী দেশ  গঠন করতে  মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন, একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশের  রাজা; যার  চিন্তায় সর্বদা থাকে জনগণের সুখ। অন্যদিকে, অসুখী হবে সেই দেশের জনগণ, যেখানে  অসহিষ্ণু রাজার  রাজ্য পরিচালনায় দূরদর্শিতার অভাবে  ভুলন্ঠিত হয়  সভ্য মানবতা। তখনই জনগণের ন্যূনতম মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার  সব দ্বারগুলো  হয়ে যায় বন্ধ । যেকোনা দেশের ঠিক এমন অবস্থায় মনে পড়ে, বিখ্যাত ফরাসি  দার্শনিক ভলতেয়ারের (১৬৯৪-১৭৭৮) একটি উক্তি: ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাব’।

দার্শনিক ভলতেয়ারের উপরের উক্তিটি বর্তমান সমাজে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক বললে অত্যুক্তি হবে না। উদাহরণস্বরূপ আমাদের বাংলাদেশে যা ঘটেছিল- ২০২৪ সাল। ছাত্র ও রাজনৈতিক দলের সাথে শাশ্বত শান্তির মানুষ যারা, তারাও  আন্দোলনে শরিক হয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রগাঢ় আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য। ফলাফল- গত সরকারকে নীল কষ্টে বিদায় নিতে হয় ৫ আগস্ট ২০২৪। সেদিন থেকে দেশ, সমাজ ও ফ্যামিলিজম নিয়ে জনগণ তথা সংবেদনশীল, বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক মানুষের চিন্তা-ভাবনার নেই অন্ত। যেমন, দেশ বিষমপদি তালের অবস্থায় কেমন চলছে অন্তবর্তী কালীন সরকার?

চিন্তুক জনগণের মনে এই ধরনের সময়োপযোগী প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। কেননা, (১) গত  সরকারের সময় তৈরি দুর্বৃত্ত -ধনীক শ্রেণীদের নিয়ে দেশ বিপদের আশঙ্কা আছে, (২) গত বছরে ভারতের নর্থ-ইস্ট নিউজে জয়দীপ সাইকিয়া নামে এক ভদ্রলোকের লিখার উপর সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘লেট আস রিটার্ন টু ঢাকা’ (২/৯/২০২৪) ; এখানে বিপদের স্কেল কিছুটা  অনুমান করা যায়, এবং (৩) গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ডক্টর ইউনূস দেশ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এইভাবে যে, ‘পতিত সরকারের কাছে থেকে আমরা পেয়েছি আতঙ্কজনক অবস্থায় দন্ডায়মান আমাদের বাংলাদেশ’।

দেশের এমন অবস্থায় জনগণের চিন্তা- ভাবনাকে প্রশমিত করার মধ্য দিয়ে একটি সুখী বাংলাদেশ উপহার দেবার জন্য গত ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে জাতীয় সংলাপ ২০২৪’। এরপরও চিন্তুক জনগণের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে যে বিষয়গুলি আছে তার মধ্যে ‘নির্বাচন ও আইনের শাসনের’  উপর দু’একটি কথা লেখা যেতে পারে।

আপনি, আমি বা আমরা সবাই জানি যে, এক রঙের ফুলের বাগানের চেয়ে বিভিন্ন রঙের ফুলের বাগান দেখতেই সুন্দর। একটি দেশে বিভিন্ন সমাজের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল, দর্শন ও মতামত থাকা সত্ত্বেও যখন একত্রে সহবস্থান করে তখন সে দেশের জনগণকে দেখে মনে হয় ঋতুরাজ বসন্তের মতো সুন্দর ও সুখী। যেমন, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীর মানচিত্রে সুখী দেশের তালিকায় এক নম্বর ফিনল্যান্ড। অন্যদিকে সুখী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সব থেকে নিচের দিকেই হতে পারে! কেননা, অর্থনীতিবীদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশের গণতন্ত্রকে ‘চোরতন্ত্রে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় উর্দি পরা কিংবা উর্দি ছাড়া আমলারা বেশি কাজ করেছে’ (প্রথম আলো, ২ ডিসেম্বর ২০২৪)।

ভাববাদী বা বস্তুবাদী কিংবা পুঁজিবাদী জ্ঞানের বিজ্ঞানীদের মতে, ‘গণতন্ত্রকে চোরতন্ত্রে পরিণত করা; এটি একটি ঘটনা প্রবাহ, যা একটি পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত’। তাই আমাদের বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর যেকোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের পরিবর্তনের পিছনে অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও বিরুদ্ধের মধ্যে সংঘাত ছিল, আছে কিংবা থাকবে। এরপরেও সভ্য জাতি তাই, পরোক্ষ গণতন্ত্র নয় বরং প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থাকে সামনে রেখে মাল্টিপোলার পৃথিবীর দিকে ধাবমান। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, করোনা ভাইরাস আক্রমণের ফলে বর্তমান পৃথিবী এক জটিল ও কঠিন সময়ের মধ্যে অবস্থান করছে। এমন অবস্থায় দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান সেনাপতি গণতান্ত্রিক সুখী বাংলাদেশ তথা জনগণের নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য সদা হন্তদন্ত। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে জনগণের নেই কোনো অন্ত। প্রশ্নের উত্তরে পাঠক ভাই, নিচের অনুচ্ছেদে যাত্রা করতে চাই!

এক.
গত রাজার রাজত্বকালে রাষ্ট্রযন্ত্র ছিদ্র হবার কারণে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের নতুন প্রত্যাশা অনুধাবন করে, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের  আলোচনা শুনে, কূটনীতিক ও গবেষকদের বিভিন্ন রিপোর্ট পাঠ করে, বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান পর্যালোচনা করে এবং নিজ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আনাগোনা দেখে মনে হচ্ছে, এবারের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য হতে পারে তিনটি এনটিটি। যেমন, এনটিটি (১) বিএনপি ও শরীক ৩-৪ টি দল, এনটিটি (২) ইসলামিক বেশ কয়েকটি দল, এবং এনটিটি (৩) ছাত্রদের দ্বারা গঠিত নতুন একটি দল; যার সাথে নেপথ্যে যোগ দিতে পারে ছোড়ভঙ্গ ছাত্ররা। প্রসঙ্গক্রমে, আমাদের মনে রাখা উচিত, এবার নির্বাচনীর দৌড়ে আইনের রায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক ছিনিয়ে নেবে তা আগে থেকে অনুমান করা, আর বোকার সাথে বন্ধুত্ব করা একই কথা।

তাই হয়তো, বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম, রাজনৈতিক ছত্রপতিদের মধ্যে তারেক রহমান বলেছেন, ‘জনগণের সমর্থন নিয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে জাতীয় সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা চায় এবং উচ্চ কক্ষসহ দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত দেখতে চায়’। প্রিয় পাঠক আপনার মন জানতে চায়, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট কি?

ফেরতা তালের মত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে থাকে দুটি কক্ষ: উচ্চ কক্ষ ও নিম্ন কক্ষ। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘দ্বিকক্ষ পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ খুব শক্তিশালী। কারণ, এই কক্ষের  সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।’ অন্যদিকে, উচ্চ কক্ষের সদস্যদের নির্বাচিত করা হয়ে থাকে বিভিন্ন পেশার জ্ঞানী-গুণী মানুষদের যারা প্রথাগত রাজনীতি করেন না; কিন্তু দেশের উন্নতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছা পোষণ করেন। 

দুই.
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশ তথা পৃথিবীতে বেশকিছু সংখ্যক জ্ঞানী-গুণী মানুষ স্বভাবজাত্যে আক্রান্ত এবং অন্ধ তাদের বক্ষস্থিত হৃদয়। তাই, উচ্চ কক্ষের সদস্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পেশার-খোলা হৃদয়ের জ্ঞানী, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব ও শ্রুতি-শক্তি সম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী মানুষদের বিবেচনা করতে পারেন, আগামী দিনের রাজা। একইসঙ্গে রাজাকে মনে রাখতে হবে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পার্লামেন্ট যদি নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ীক আর আমলারা। তবে আবারও ‘বাংলাদেশে দুর্জন-দুর্বৃত্তরা গাড়ি ঘোড়ায় চড়বে আর সুখী দেশ গড়ার ধীমানেরা ওদের গাড়ীর নীচে চাপা পড়বে’। দেশের শাসন ব্যবস্থায় প্রচলিত আইনে বিচারের আশায় এই ধীমানদের ফিরে যেতে হবে বহু সহস্রাধিক বছর আগে! লেখার কলেবর বাড়ানোর জন্য নয়, এখানে দু'একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এভাবে, উদাহরণ এ- মধ্যযুগ। স্পেনে প্রায় তিনশত বৎসর বর্বর ভিজিগদের দুঃশাসনের (৪০৯-৭১১) রাজত্ব। শাসন ব্যবস্থায় রাজা, ধর্ম যাজক এবং অভিজাত শ্রেণী করমুক্ত। অন্যদিকে কৃষক ও কৃতদাস শ্রেণী সঠিক সময়ে কর দিতে না পারলে, আইনের শাসন অনুযায়ী, শাসক শ্রেণী অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতন করতো।

উদাহরণ বি- মধ্যযুগে ভিজিগদের রাজত্বের কাছাকাছি- দ্যা এজ অফ ইম্পায়ার্স। ধনীদের অধীনে পরিচালিত রাজ্য শাসন ব্যবস্থার যুগ। এই যুগে চিকিৎসকের সেবা গ্রহণ করার পরে যদি কোনো ধনী গোষ্ঠীর রোগী মারা যেত, তখন সেই চিকিৎসকের হাত কেটে ফেলা হতো এবং ধনীদের অপরাধকে পরোক্ষভাবে দেখা হতো ছোট করে। আর পেশাজীবী ও দাসদের অপরাধকে দেখা হত খুব বড় চোখে।

ব্যবিলিয়নের ৬ষ্ঠ রাজা হাম্মুরাবি কোডের অন্তর্গত উপরের আইনগুলো অন্যরূপে কিংবা অন্যভাবে এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত থাকলেও থাকতে পারে! কারণ গত রাজার সময় আইনের শাসন পরিচালনার নেপথ্যে কাজ করেছিল যারা, অকাট মূর্খ ধনী গোষ্ঠী কিংবা পল্লবগ্রাহী ধীমান ছিল তারা। এরাই দেশের রাজনৈতিক পরিচয়ের চাদর পড়ে যৌথভাবে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বঙ্কিম চন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস বিষবৃক্ষকে করেছিল সমুদ্ভাসিত। তারপরও জনগণ আশা করে, দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচিত রাজা নরসুন্দর ডেকে দুর্বৃত্ত -ধনীক শ্রেণী নামক নরপিশাচ ও নরাধমদের মাথার চুল কেটে, ধিক্কার জানাবে ওদের চিহ্নিত বড় চোর হিসেবে। আগামীদিনের রাজা এই কাজটি করতে পারলেই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্মুক্ত হবে সুশাসনের বায়ু প্রবাহের পথ।

অন্যদিকে, দেশের রাজা যদি দুর্বৃত্ত-ধনীক শ্রেণীর সদস্যদের আইনের শাসনে বড় চোর হিসেবে ধরতে না পারেন, তবে এই মহা সত্য কথা অপ্রকাশ্য থেকে যাবে সমাজে। যেমন করে (১), অপ্রকাশ্য থেকে যায় জীবন চলার পথে অনেক সত্য কথা। (২), সাহিত্য রচনায় যেমন করে উন্মোচিত হয় না অনেক সত্য ঘটনা। আমরা বিশ্বাস করি সত্য কখনই তার গন্তব্যের গতিপথ পরিবর্তন করে না। ঠিক  তেমনি, নিকট ভবিষ্যতের রাজা সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে পাখোয়াজ বাজিয়ে সাধুবাদ জানাবেন দেশপ্রেমিক মানুষদের, যারা গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধি, শক্তিশালী ও  ঐক্যের বাংলাদেশে আইনের শাসন পরিচালনা জন্য, সমাজের গভীরতর অসুখের মূলোৎপাটনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে কখন কুণ্ঠাবোধ করে না।

উপরের আলোচনা ও উদাহরণ ফেরেজবাজ, মূর্খ ধনী গোষ্ঠী কিংবা বাকসর্বস্ব, বাক্যবাণ ও পল্লবগ্রাহী ধীমানদের জলসা ঘরে জলাতঙ্ক রোগ সৃষ্টি করলেও করতে পারে। তবে বর্তমানে বাংলার রাজনৈতিক ছত্রপতি ও ভবিষ্যৎ রাজাকে বাহ্যদৃষ্টি নয় বরং বাহ্যেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বুঝতে হবে অনেকটা এভাবে, (১) দেশে নির্বাচন, আইনের শাসন, জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে ‘কেনো সংবেদনশীল, বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক মানুষের চিন্তা-ভাবনার নেই অন্ত?’ এই প্রশ্নের উত্তরের ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে পারলেই আগামী দিনের রাজার কর্ণমহোদ্বয় বুঝতে পারবে, জনগণের আলোচনার উদ্দেশ্য ও গূঢ় রহস্য।

প্রিয় পাঠক, আপনাকে বলতে চাই, এখনো দেশে অদৃশ্য উপনিবেশ চলছে ও চলবে। তারপরও রাজনৈতিক ছত্রপতি ও ভবিষ্যৎ রাজার উঁচু মানের নেতৃত্ব, সঠিক পরিকল্পনা, সাহসী পদক্ষেপ, ইতিবাচক দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে দেশে যখন প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। ঠিক তখন, জনগণের কাছে বাংলাদেশকে মনে হবে ঋতুরাজ বসন্তের মতো একটি সুন্দর ও সুখী দেশ।  

লেখক : ড. মো. মঞ্জুরে মওলা, সমাজবিজ্ঞানী, টেকসই রিনিউবল এনার্জি ও সার্কুলার অর্থনীতি এক্সপার্ট
 

Read Entire Article