ঘুম এখন একপ্রকার বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। আমরা সবাই জানি ঘুম কতটা জরুরি, কিন্তু আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, সন্তান পালন, উদ্বেগ, কিংবা স্মার্টফোনের নীল আলো— সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ ঘুম যেন দূরের স্বপ্ন। অথচ পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘুম কেবল বিশ্রাম নয়; এটি সুস্থ জীবনের অন্যতম স্তম্ভ। যেমন সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত শরীরচর্চা দরকার, তেমনি পর্যাপ্ত ঘুমও শরীর ও মনের ভারসাম্য রক্ষা করে।
ঘুম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
স্বাস্থ্যর তিনটি মূল স্তম্ভ হলো পুষ্টি, শরীরচর্চা ও ঘুম। এই তিনটি একে অপরের পরিপূরক। ঘুম ঠিক না হলে খাওয়ার অভ্যাসও বিঘ্নিত হয়। যারা ঘুম কমায়, তাদের মধ্যে চিনি ও কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। আবার ক্লান্ত শরীর নিয়ে শরীরচর্চা করাও কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সুস্থ থাকতে চাইলে তিনটি স্তম্ভই ঠিক রাখতে হবে।
প্রাপ্তবয়স্কদের কত ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন?
গবেষণা বলছে, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম সবচেয়ে উপযুক্ত। অনেকে বলেন, চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমেই তারা সতেজ থাকেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রকম ‘শর্ট স্লিপার’ খুবই বিরল।
তাদের দাবি, অনেকেই ঘুমের ঘাটতি পুষিয়ে নেন কফি বা এনার্জি ড্রিঙ্ক খেয়ে, যা সাময়িকভাবে জেগে রাখলেও শরীরের ভেতর ধীরে ধীরে ক্লান্তি ও মানসিক চাপ বাড়ায়।
তবে শুধু সময় নয়, ঘুমের মানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত সময় ধরে, নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘুমানোই ভালো ঘুমের চাবিকাঠি।
শিশুদের ঘুমের সময়সূচি
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (HHS) হিসাব অনুযায়ী, শিশুদের বয়স অনুযায়ী ঘুমের সময় এমন হওয়া উচিত—
নবজাতক : দিনে ১৪-১৭ ঘণ্টা
শিশু (৪-১২ মাস) : দিনে ১২-১৬ ঘণ্টা
টডলার (১-২ বছর) : দিনে ১১-১৪ ঘণ্টা
প্রি-স্কুলার (৩-৫ বছর) : দিনে ১০-১৩ ঘণ্টা
স্কুলগামী শিশু (৬-১২ বছর) : রাতে ৯-১২ ঘণ্টা
কিশোর (১৩-১৮ বছর) : রাতে ৮-১০ ঘণ্টা
ঘুমের অভাবে যেসব রোগের ঝুঁকি বাড়ে
যথেষ্ট ঘুম না পেলে বা ঘন ঘন ঘুম ভাঙলে শরীরে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫টি প্রধান মৃত্যুর কারণের মধ্যে সাতটির সঙ্গে ঘুমের ঘাটতির সরাসরি সম্পর্ক আছে। এর মধ্যে রয়েছে,হৃদরোগ, ক্যানসার, মস্তিষ্ক ঘটিত রোগ (স্ট্রোক, অ্যানিউরিজম), দুর্ঘটনা, ডায়াবেটিস, সেপসিস ও উচ্চ রক্তচাপ।
অর্থাৎ ঘুম থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা মানে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের স্বাভাবিক কাজকে বাধাগ্রস্ত করা।
ভালো ঘুমের জন্য কিছু সহজ টিপস
১. রাতের খাবারের পর চিনি, ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
২. ঘুমানোর দুই ঘণ্টা আগে টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপ বন্ধ রাখুন।
৩. স্মার্টফোন বা ট্যাব বেডরুমে না রাখাই ভালো।
৪. ঘর যতটা সম্ভব অন্ধকার রাখুন, আলো মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে।
৫. ঘুম ভাঙানোর জন্য স্মার্টফোন নয়, অ্যালার্ম ঘড়ি ব্যবহার করুন।
৬. ঘরের তাপমাত্রা ঠান্ডা রাখুন (প্রায় ১৮-২০° সেলসিয়াস)।
প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও জাগার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
শেষ কথা
ঘুম শরীরের রিচার্জিং সিস্টেম। নিয়মিত, নিরবচ্ছিন্ন ও পর্যাপ্ত ঘুম মানে সুস্থ মন, স্থিতিশীল মস্তিষ্ক ও রোগপ্রতিরোধী শরীর। তাই ঘুমকে অবহেলা নয়, প্রাধান্য দিন প্রতিদিনের জীবনের সবচেয়ে প্রাকৃতিক এই চিকিৎসাটিকে।
সূত্র : ডেভিস হেল্থ ও মায়ো ক্লিনিক