এক সময় ভ্রাম্যমাণ নাপিতদের কাছে চুল-দাড়ি কাটার জন্য মানুষের ভিড় লেগে থাকতো। গ্রাম থেকে শহর সবখানেই দেখা যেত তাদের। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ আর তাতে চুল কাটার সব সরঞ্জাম নিয়ে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই দৃশ্য এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা সেলুন আর জেন্টস পার্লারের কারণে মাদারীপুর থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন ভ্রাম্যমাণ নাপিতরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর শহরের ডিসি ব্রিজ এলাকার বটগাছের নিচে, হাসপাতালের সামনে, ইটেরপুল, চৌরাস্তা, পানিছত্র, জজকোর্টের সামনে, পুরাতন কোর্ট এলাকা, পুরানবাজারের বিভিন্ন রাস্তারপাশেসহ গ্রামের হাট-বাজারে, বটগাছের নিচে, খেয়াঘাটে, গ্রামের দোকানপাটের সামনেসহ নানা জায়গায় বসতেন ভ্রাম্যমাণ নাপিতরা। নাপিতরা পুটলির মধ্যে করে বা কাঠের বাক্সের মধ্যে কাচি, ব্লেড, খুর, চিরুনি, সাবান, ফিটকারি, পাউডার, লোশনসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখতেন। সঙ্গে বসার জন্য পিঁড়ি বা কাঠের টুল থাকতো। চুল কাটার জন্য সেই পিঁড়ি বা টুলে বসতেন, সামনে থাকতো আয়না ঝুলানো। আর নাপিতরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী চুল-দাড়ি কাটতেন।
আধুনিকতার ছোয়ায় এখন আর সেই পরিচিত দৃশ্য তেমন একটা চোখে পরে না। নাপিতরা এখন স্থায়ী দোকান নিয়ে বসেছেন। এছাড়াও ছেলেদের জন্য গড়ে উঠেছে জেন্টস পার্লার। দিনদিন সেই পার্লারগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ নাপিতের কাজ।
জেলার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহর এলাকায় তেমন ভ্রাম্যমাণ নাপিত দেখা যায় না। তবে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর কিছু হাট-বাজারে এখনো দেখা মেলে তাদের। তবে সেটিও হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। নতুন প্রজন্মের কাছে নাপিতদের এই ভ্রাম্যমাণ চুল-দাড়ি কাটা, সেভ করার বিষয়টি ইতিহাস হতে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
ষাট বছর বয়সী দেলোয়ার হোসেন বলেন, আগে আমরা রাস্তার পাশে বসে চুল কাটতাম। এখন আর শহরে এই দৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া সেলুনে বা পার্লারে চুল-দাড়ি কাটার সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতিতেও পরিবর্তন হয়েছে। আগের সেই সব জিনিসও নেই।
মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়ার হাটের নাপিত সুবেদ শীল বলেন, এখন আর আমাদের কাছে তেমন একটা মানুষজন আসে না। তাই হাটের দিন ৩০০-৪০০ টাকা উপার্জন হয়। তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। অন্য কোনো কাজ জানি না, তাই এই পেশাও ছাড়তে পারছি না।
আরও পড়ুন:
- জলবায়ু বিপর্যয়ে কখনো পুড়ছে কখনো ডুবছে সিলেট
- ‘বাবা উঠো, মজা আইন্না দাও’ কবরের কাছে গিয়ে বলে ছোট্ট সাজিদুল
কালকিনির গোপালপুর হাটের নাপিত বিজয় শীল বলেন, এই পেশায় আমার দাদা ছিলেন, এরপর আমার বাবা করেছেন। এখন আমি করছি। তবে আমার ছেলেকে পড়ালেখা করাচ্ছি। সে অন্য পেশায় কাজ করবে। কারণ এখন আর এই পেশার কদর নেই। আর কয়েক বছর পর এই পেশার কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, কালের বিবর্তনে মাদারীপুরে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে রাস্তার পাশে, গাছের নিচে বা হাট বাজারের টুল-পিঁড়িতে বসে চুল দাড়ি কাটার দৃশ্য। তবে বহু বছর আগে নাপিতদের কাছে পিঁড়ি বা টুলও ছিল না, তখন ইটের ওপর বা কাঠের টুকরোর ওপর বসিয়ে চুল কাটতো। এসব দৃশ্য এখন আর নেই। দুই একজন যারা আছেন, তারাও হয়ত এক সময় হারিয়ে যাবেন। বর্তমানে এই পেশা প্রায় বিলুপ্তির পথে।
উন্নয়ন সংস্থা তারুণ্য পরিবারের সোহাগ হাসান বলেন, বর্তমানে সবাই সেলুনগুলোতে চুল কাটে। একটা সময় আসবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পিঁড়ি বা টুলে বসে চুল ও দাড়ি কাটার এই দৃশ্য গল্পের মধ্যেই চলে যাবে। বিশাল আয়না, চেয়ার, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সাজসজ্জার নানা প্রসাধনীর ভিড়ে ভ্রাম্যমাণ নাপিতদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এমএন/এমএস