সোনা চোরাচালানে জড়াচ্ছেন বিমানের ক্রুরা, ‘লঘু শাস্তিতে’ রেহাই

1 day ago 5

আকাশপথে সোনা চোরাচালান চক্রে জড়াচ্ছেন রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রুরা। কিছুদিন পরপরই বিমানবন্দরে সোনাসহ ধরা পড়ছেন তারা। ধরা পড়লেও লঘু শাস্তি দিয়ে পুনরায় ফেরানো হচ্ছে চাকরিতে।

বিমানের ‘দায়সারা’ শাস্তিতে এ ধরনের অপরাধ থেকে কেবিন ক্রুদের বিরত রাখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি সোনাসহ ধরা পড়েছেন বিমানের ফ্লাইট পার্সার বিভাগের ক্রু রুদাবা সুলতানা।

অভিযোগ রয়েছে, একের পর এক কেবিন ক্রু সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ায় রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তারা বেশি আয়ের লোভে গুরুতর এ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু আটকের পর তাদের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা হয় না। কাস্টমস কর্মকর্তারা সোনা জব্দ করে শুধু বিমানে একটি চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবগত করেন। পরে বিমান প্রাথমিক তদন্ত করে সত্যতা মিললে বিভাগীয় মামলা করে। এছাড়া অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে নামমাত্র শাস্তি দিয়ে অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দিয়ে পুনরায় কাজে যোগদানের অনুমতি দিচ্ছে সরকারি সংস্থাটি।

তবে বিমান কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা কেবিন ক্রুদের সোনা চোরাচালান বন্ধ ও শাস্তির বিষয়ে তৎপর। ক্রুদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ীই তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যদিও এর ফলে অনেক কেবিন ক্রু ফের ফ্লাইটে ওঠার সুযোগ পাচ্ছেন।

সোনা চোরাচালানে জড়িতদের ‘দায়সারা শাস্তি’

বিমানের গ্রাহক সেবা বিভাগ সূত্র জানায়, গত জানুয়ারিতে সোনার বারসহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়েন বিমানের কেবিন ক্রু মর্জিনা আক্তার এলিন। তখন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিমান। ১৮ মার্চ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। সংস্থাটির তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পান তদন্তকারী কর্মকর্তা।

বিমান প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে। এখানে কারও পক্ষে কাজ করার সুযোগ নেই। কেবিন ক্রুদের অপরাধমূলক কার্যক্রমের ওপর বিশেষ নজর রাখছে বিমান। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এ বি এম রওশন কবির

পরে গত ২৮ আগস্ট মর্জিনা আক্তার এলিনকে দুটি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বন্ধের দণ্ড দিয়ে অফিস আদেশ জারি করে বিমান। একই অফিস আদেশে তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারও করা হয়। ফলে কয়েক দিন আগে বিমানের গ্রাহকসেবা বিভাগে ফের যোগ দিয়েছেন ওই কেবিন ক্রু।

আরও পড়ুন

২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর সোনার বারসহ শাহজালাল বিমানবন্দরে ধরা পড়েন কেবিন ক্রু সাদিয়া খানম। পরদিন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিমান। পরে গত বছরের ২৭ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাদিয়া খানমের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পান। কিন্তু তারপরও গত ১৭ আগস্ট সাদিয়া খানমকে ‘তিরস্কার’ দণ্ড দিয়ে অফিস আদেশ জারি করে বিমান। একই সঙ্গে তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশও প্রত্যাহার করা হয়।

ওই দুটি অফিস আদেশেই সই করেন বিমানের পরিচালক (প্রশাসক ও মানবসম্পদ) মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম। তবে তিনি এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সোনা চোরাচালানের এসব ঘটনা তদন্ত করে বিমানের প্রশাসক বিভাগ। এ বিভাগের যারা তদন্তকারী কর্মকর্তা থাকেন, তাদের অনেকে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দেন। এছাড়া কেবিন ক্রু ইউনিয়নের প্রভাবশালী নেতারাও অভিযুক্ত কেবিন ক্রুদের দায়মুক্তির জন্য প্রভাব বিস্তার করেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এ বি এম রওশন কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমান প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে। এখানে কারও পক্ষে কাজ করার সুযোগ নেই। কেবিন ক্রুদের অপরাধমূলক কার্যক্রমের ওপর বিশেষ নজর রাখছে বিমান। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সোনা চোরাচালানের আলোচিত যত ঘটনা

গত ৪ আগস্ট সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে বিজি-৩৪০ ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছান বিমানের জ্যেষ্ঠ কেবিন ক্রু রুদাবা সুলতানা। গ্রিন চ্যানেল পার হওয়ার সময় তাকে সন্দেহ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। এসময় তিনি পোশাকের ভেতরে লুকানো একটি টিস্যু পেপার বের করে পা দিয়ে স্ক্যানিং মেশিনের নিচে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। টিস্যুর ভেতর থেকে ২৪ ক্যারেটের ২৩০ গ্রাম ওজনের দুটি সোনার চেইন উদ্ধার করা হয়, যা অবৈধ পণ্য হিসেবে জব্দ করা হয়। ওই ঘটনায় গত ১২ আগস্ট তাকে বরখাস্ত করে বিমান। ওই বরখাস্ত আদেশে রুদাবার এ ধরনের আচরণ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করেছে উল্লেখ করা হয়।

সম্প্রতি জয়েন করা একজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর আগে কয়েকজন কেবিন ক্রুকে এমন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে যারা বিমানের পারমানেন্ট স্টাফ তাদের আমরা ডিমোশন করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে আরও স্ট্রিকলি এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।- বিমানের এমডি ও সিইও ড. সাফিকুর রহমান

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাস্টমসের এক কর্মকর্তা জানান, রুদাবা সুলতানা বিমানের একজন প্রভাবশালী কর্মী এবং কেবিন ক্রু ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আবিরের বোন। সেই প্রভাব ব্যবহার করে তিনি ওইদিন ধরা পড়ার পরও বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাকে রক্ষায় প্রভাবশালী মহলের পক্ষ থেকেও চেষ্টা চালানো হয়েছিল।

এ বিষয়ে রুদাবা সুলতানার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তার ভাই কেবিন ক্রু ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আবিরকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে প্রতিবেদকের নাম-পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেবিন ক্রু ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শামীম আক্তার লোটাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণত বিমানের কেবিন ক্রুদের স্বার্থ দেখাই ইউনিয়নের কাজ। তারপরও নিয়ম অনুযায়ী কোনো কেবিন ক্রু অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে ইউনিয়নের একজন সদস্য থাকেন। ইউনিয়নের এ সদস্য নিরপেক্ষ থেকেই তদন্ত কাজে সহযোগিতা করেন। আবার অপরাধ এক ধরনের, কিন্তু শাস্তি ভিন্ন এমন ঘটনায় ইউনিয়ন সদস্য আপত্তি জানান।’

২০২৩ সালের জুনে সাতটি সোনার বার নিয়ে ঢাকায় ফেরার সময় সৌদি আরবের জেদ্দায় কিং আব্দুল আজিজ বিমানবন্দরে আটক হন বিমানের কেবিন ক্রু জিয়াউল হাসান। তখন তাকে বিমান থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ ঘটনায় বিমানের সহকারী ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মাছুদুল হাছান বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলাও করেন। এ মামলা এখনো চলমান।

২০২২ সালের জুনে সৌদি আরবের জেদ্দায় তিন কোটি টাকার সোনা ও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাসহ ফ্লোরা নামে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এক কেবিন ক্রু আটক হন। এ ঘটনায় তাকেও চাকরিচ্যুত করে বিমান।

যা বলছেন বিমান এমডি

জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. সাফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেবিন ক্রুরা বিমানে যোগ দেন গ্রুপ-৪ এ। পরে প্রমোশনের মাধ্যমে তাদের পদোন্নতি হয়। আইন অনুযায়ী, কেবিন ক্রুরা কেউ বড় ধরনের অপরাধ করলে তার চাকরি চলে যেতে পারে। আবার কেউ যদি একটি গোল্ডবার নিয়ে আসে এজন্য তো তার চাকরি যাওয়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে আমরা সেকেন্ড শাস্তি দেই। সেটা হলো র্যাংঙ্ক ডিমোশন করি। কিন্তু নতুন যারা জয়েন করে তাদের ক্ষেত্রে যেহেতু ডিমোশনের সুযোগ নেই, তখন আমরা বলি এক বছর তার প্রমোশন হবে না, এক বছর বেতন বাড়বে না।’

তিনি বলেন, ‘এক বছর বিমান থেকে কোনো বেনিফিট পাবেন না। সম্প্রতি জয়েন করা একজনকেও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর আগে কয়েকজন কেবিন ক্রুকে এমন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে যারা বিমানের পারমানেন্ট স্টাফ তাদের আমরা ডিমোশন করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে আরও স্ট্রিকলি এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’

এমএমএ/এএসএ/এমএফএ/এমএস

Read Entire Article