সোনার হরিণ এবং আলাদিনের দৈত্য

3 months ago 19

আমাদের পাড়ায় মাত্র দুজন ছিলেন সরকারি চাকরীজীবি। তারা ছিলেন ভূমি অফিসের কেরানি। অবশ্য তারা কেউই এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না। তারা বাংলাদেশের একটা বিশেষ জেলার মানুষ ছিলেন। যে জেলার একজন মানুষ কোন অফিসে ঢুকলে তার পুরো পরিবারকে সেই অফিসে ঢুকিয়ে দেয়। তারাও ছিলেন সম্পর্কে চাচা ভাতিজা। আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন কৃষিজীবী অথবা দিনমজুর।

এই চাচা ভাতিজা হয়তোবা সেই কারণেই আমাদের পাড়াকে বেছে নিয়েছিলেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। এরপর দিনে দিনে তাদের সহায় সম্পত্তি বেড়ে গিয়ে আকাশচুম্বী হয়েছিল। আমরা জানতাম তারা যে বেতনের কর্মচারী সেই বেতনে তাদের সংসারই চলার কথা না। কিন্তু তাদের স্বচ্ছলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। গ্রামের মানুষ তাদের সামনাসামনি সম্মান দেখালেও পেছনে কটূ কথা বলতে ছাড়তেন না।

সরকারি চাকরির সোনার হরিণ হাতে পাবার পর এক একজন সরকারি কর্মকর্তা রাতারাতি আলাদিনের দৈত্য বনে যান এবং পরিবারের, বন্ধুদের, সমাজের ইচ্ছে পূরণে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ খুব ভালো করেই জানে যে সরকারি চাকরিজীবির বেতনের চেয়ে উপরি আয় বেশি। তাই তারা আত্মীয়তা করার সময় তাদের সবার ওপরে গুরুত্ব দেয়। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবি পাত্রের কদর শহর গ্রাম নির্বিশেষে অনেক বেশি। আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করছি। কিন্তু এই অবস্থার খুব একটা হেরফের হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউ সরকারি চাকরিজীবি হলেই সাধারণ মানুষের অনেক ধরনের চাহিদা তৈরি হয়।

এলাকার মানুষকে চাকরি দেবে, এলাকার মসজিদ মাদরাসা এতিমখানায় দান খয়রাত করবে, অভাবী দুঃখীদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু মানুষ এটাও জানে যে তিনি যে বেতন পান তাতে তার নিজেরই ভালো মতো চলতে পারার কথা না। তবুও মানুষ এগুলো আশা করে শুধুই বসে থাকে না অনেকসময় রীতিমত তাগাদাও দেয়। এ এক অদ্ভুত মনোস্তাত্বিক ব্যাপার। সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয় এর পেছনের কারণ সম্মন্ধে ভালো বলতে পারবেন।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরির সবচেয়ে উঁচু ধাপ হচ্ছে বিসিএস ক্যাডার। স্নাতক পাশ যে কেউই বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন। আর এটা আলাদা একটা পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পাস করার জন্য অসীম পরিমাণ হাবিজাবি পড়াশোনা করতে। হাবিজাবি বলছি কারণ এই পড়াশোনা আদতে চাকরিজীবনে বা ব্যক্তি জীবনে কোনো কাজে আসে না। প্রাথমিক ধাপে সবাইকে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের একটা সাধারণ পরীক্ষা দিয়ে লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।

লিখিত পরীক্ষায় প্রত্যেকের জন্যই সাধারণ কিছু বিষয় নির্ধারিত আছে। এছাড়াও বিশেষায়িত ক্যাডারের জন্য সেই বিষয়ের বাড়তি আরো দুটো পরীক্ষা দিতে হয়। এই ধাপ পার হলে আছে মৌখিক পরীক্ষা নামের আরেক বিভীষিকা। এতগুলো ধাপ পার হলেই কেবল সরকারি চাকরি নামের সোনার হরিণের দেখা মেলে।

সরকারি চাকরি স্থায়ী করণের তিনটা শর্ত আছে। ন্যূনতম দুই বছর চাকরি করতে হয়। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষ করতে হয়। আর বিভাগীয় পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে হয়। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে একেবারে হাতে কলমে এক একজনকে রাতারাতি অসাধারণ মানুষ করে তোলা হয়। একজন সরকারি কর্মকর্তার চলাফেরা, কথাবার্তা, চালচলন, খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুই শেখানো হয়। এতে করে একজন কৃষকের ঘরে জন্ম নেওয়া এবং পান্তাভাত খেয়ে দিন শুরু করা ছেলেও রাতারাতি কাটা চামচ এবং ছুরি দিয়ে খাওয়া শিখে যায়।

এভাবেই সে নিজেকে দিন দিন অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবতে শুরু করে। সাধারণ জনগণের প্রভু হয়ে উঠার শিক্ষাটা এখান থেকেই আসে। আর বিভাগীয় পরীক্ষায় সরকারি সকল প্রকার নিয়ম নীতির পরীক্ষা নেওয়া হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেই কেউ যদি এই নিয়মকানুনগুলো ঠিকঠাক পড়েন তাহলে আর তাকে দিয়ে কোনো দুর্নীতি সম্ভব না। কিন্তু বাস্তবে ঘটে এর উল্টোটা। সবাই আইন জেনে এর ফাঁকফোকরগুলো বের করে ফেলেন। যত বেশি আইন তত বেশি ফাঁকফোকর।

সিভিল সার্ভিসে সাধারণ ও কারিগরি/পেশাগত-২ ক্যাটাগরিতে মোট ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। কিন্তু সবাই তিনটা ক্যাডারকে প্রাধান্য দেয় - প্রশাসন, পুলিশ এবং শুল্ক ও আবগারি। কারণ এগুলোতে ক্ষমতা চর্চার সুযোগ অনেক বেশি। পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও বেশি। আর অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় অর্থযোগও বেশি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠ প্রশাসনে সহকারী কমিশনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর একে একে পদোন্নতি পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হয়ে সিনিয়র সচিব হয়ে থাকেন।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একটি উপজেলার সর্বময় কর্তা। চাকরির শুরুতে পুলিশ ক্যাডারের পদের নাম সহকারী পুলিশ সুপার। এরপর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি, অতিরিক্ত আইজিপি ও আইজিপি পর্যন্ত হওয়া যায়। শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারের শুরুর পদ হলো সহকারী কমিশনার। এরপর একে একে পদোন্নতি পেতে থাকেন।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে সারা বিশ্বেই সরকারি চাকরির প্রতি মানুষের অনীহা তৈরি হচ্ছে। বরং মানুষ বিভিন্ন স্বাধীন পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ চলেছে উল্টোরথে। এখানে সময়ের সাথে সাথে সবাই সোনার হরিণ পেতে চাইছে। কারণ একবার কেউ এটা পেয়ে গেলে সেটা আর হারানোর ভয় নেই। সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন কিন্তু যাওয়া অসম্ভব। তাই সবাই সামাজিক এবং আর্থিক সুরক্ষার জন্যই এটাকে বেছে নিচ্ছে বলেই আমার ধারণা।

অনেকেই নতুন প্রজন্মের সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়াটাকে ভালোভাবে দেখছেন কিন্তু আমি দেখি না কারণ আমি জানি এরা কেউই দেশপ্রেম বা দেশের সেবা করার ব্রত নিয়ে এই চাকরিতে আসছে না বরং নিজের এবং পরিবারের সামাজিক এবং আর্থিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যই আসছে। কোনো পরিবারে একজন সরকারি চাকরিজীবি থাকা মানে রাতারাতি সমাজে তাদের অভিজাত অবস্থা তৈরি হয়ে যায়।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে সংবাদপত্রগুলো সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশ করার পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষার জন্য আলাদা পাতাও প্রকাশ করে। এটাকে আমার কাছে সবচেয়ে বড় ভন্ডামি মনে হয়। অনেকেই বলতে পারেন যে সবাই তো আর দুর্নীতিগ্রস্ত না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে সেই সংখ্যাটা কত। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রত্যেক সরকারি দপ্তরেই একেবারে হাতেগোনা কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী থাকেন যারা সৎ। আসলে তারাই পুরো সিস্টেমটাই শক্ত হাতে ধরে রাখেন ফলে সেটা ভেঙে পড়তে যেয়েও পড়ে না।

এটা করতে গিয়ে সেই মানুষগুলো একেবারে সাধারণ জীবন যাপন করেন। সবচেয়ে দুৰ্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে তাদের এই সততা তাদের পরিবার, বন্ধুমহল, সমাজ এবং অফিসে অন্যদের জন্য আলোচনার এবং হাস্যরসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে আর কেউই আসলে নিজেকে সৎ রাখতে উৎসাহ পায় না বরং স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। যেমন চলছে চলুক। কারণ স্রোতের বিপরীতে চলতে গেলে অনেক ঝুঁকি থাকে এমনকি প্রাণনাশের সম্ভাবনাও আছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

দেশে কিংবা প্রবাসে বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবিদের নিয়ে মানুষের মনোভাব একই। আমরা স্বামী স্ত্রী প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি এটা প্রবাসের মানুষজন অনেকেই বিশ্বাস করেন না। সোনার ডিম দেওয়া হাঁসকে নিশ্চয়ই কেউ ফেলে দেয় না। এক বাসায় দাওয়াতে গিয়ে দেশ থেকে আসা এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো। তিনি ধর্মের অনেক নিয়মকানুন সহীভাবে আমাদের বুঝাচ্ছিলেন।

তিনি দেশে কোনো একটা সরকারি দপ্তরে কেরানির কাজ করতেন। যেই শুনলেন আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি সেই তিনি বলতে শুরু করলেন আমি একটা বিশাল ভুল করেছি। আমি তখন বুঝলাম তিনি আসলে কি বলতে চাইছেন। তিনি নিজেও জীবনের সব উপার্জন দিয়ে প্রবাসে থাকা মেয়ে জামাইকে ব্যবসা কিনে দিয়েছেন। আমাদের ধর্ম পালন এবং দুর্নীতির মহোৎসব আসলে পাশাপাশি চলে। বিষয়টা এমন যে একটা দিয়ে অন্যটা কাটাকাটি হয়ে যায়। দেশের সরকারের দুর্নীতি নিয়ে মুণ্ডুপাত করা প্রবাসীদের অন্যতম বড় বিনোদন। কিন্তু এরাই আবার যখন দেশ থেকে কোন মন্ত্রী বা আমলা আসেন তাদের সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে ক্ষমতার সাথে নিজেদের যোগসূত্র জাহির করেন।

প্রবাসের বেগমপাড়া এখন অপ্রিয় সত্য। আর দেশে বেনজীর মতিউর তো হাজারে হাজার। সম্প্রতি একটা পত্রিকার পাতায় মতিউরের গ্রামে গিয়ে কি জানা গেলো সেই প্রতিবেদন পড়লাম। সেখানে গ্রামের একজন বলেছেন, মতিউর সাহেব অনেক ভালো মানুষ। শুধু শুধু তার নামে বদনাম করা হচ্ছে। আরেকজন বলেছেন, ‘সবার মাথার চুলই তো কালো!’ এটাই আসলে সবচেয়ে সত্যি কথা। আপনি আসলে কাকে ছেড়ে কাকে ধরবেন।

পুরো একটা দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা এভাবেই বিবর্তিত হচ্ছে। তবে আশাবাদী হয়েছিলাম তথ্য প্রবাহের অবাধ প্রচার দেখে। এইবার নিশ্চয়ই একে একে মানুষ সরকারি লোকজনের দুর্নীতি প্রকাশ করতে শুরু করবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। কারণ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছাগল-কাণ্ড তুলে ধরা সাইয়েদ আবদুল্লাহর ‘অ্যাকাউন্ট’ স্থগিত করেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।! তখন বুঝলাম আসলে দুর্নীতি থেকে আমাদের মুক্তি নেই। এটাকে যত দ্রুত আমরা আমাদের জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেব জীবনযাপনততই সহজ হবে?

এমআরএম/এএসএম

Read Entire Article