‘স্ত্রী’ দাবি সাবেক ইডেন নেত্রীর, ‘প্রতারণা’ বললেন ছাত্রলীগ নেতা

4 months ago 53

রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সবশেষ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তানজিয়া আক্তার লাবণ্যর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ফুয়াদ হাসান শাহাদাত। এ অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় পৃথক তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ছাত্রলীগের এ নেতা। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও অ্যাপের সাহায্যে তাকে ফাঁসানো হতে পারে বলেও অভিযোগ করেন শাহাদাত।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তানজিয়া আক্তার লাবণ্য দাবি করেছেন, ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত তাকে বিয়ে করেছেন। যদিও এর পক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

জিডিতে যেসব অভিযোগ করেন শাহাদাত
গত বছরের ৩ নভেম্বর ছাত্রলীগ নেতা ফুয়াদ হাসান শাহাদাত হাজারীবাগ থানায় একটি জিডি করেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, তানজিয়া আক্তার লাবণ্যর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে তার পরিচয়। এরপর বন্ধুত্বের সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে ঘুরতে যান তারা। সেসময় কৌশলে তার ছবি তুলেন লাবণ্য। পরবর্তী সময়ে লাবণ্য তার কাছে বাসাভাড়া ও খরচের টাকা দাবি করেন ও দিতে বাধ্য করেন। টাকা না দিলে তার কাছে থাকা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

গত ৪ এপ্রিল পল্লবী থানায় আরও একটি জিডি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের সাবেক এ সাধারণ সম্পাদক। এবারের জিডিতে শাহাদাত উল্লেখ করেন, ‘তানজিয়া (লাবণ্য) নিজেকে আমার স্ত্রী দাবি করে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের থেকে টাকা নেন। যদিও তার সঙ্গে আমার কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক নেই।’

এআই দিয়ে ফাঁসানোর আশঙ্কা
গত ৭ এপ্রিল রাজধানীর শাহবাগ থানায় আরেকটি জিডি করেন শাহাদাত। এতে তিনি আশঙ্কা করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যাপের সাহায্যে লাবণ্য তাকে ফাঁসাতে পারেন। জিডিতে শাহাদাত উল্লেখ করেন, ‘গত ৩ এপ্রিল ওই তরুণী হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কল দিয়ে আমাকে বলেন তার কথা যদি না শুনি এবং কথামতো যদি কাজ না করি, তাহলে তিনি তার কণ্ঠ নকল করে এআই ও অ্যাপের মাধ্যমে অপ্রীতিকর মন্তব্যের ছোট ছোট অডিও ক্লিপ বানিয়ে সবার কাছে পাঠাবেন। কণ্ঠ ক্লোন করে এসব ক্লিপ বানানো হবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের নিয়ে, যাতে খারাপ ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করা হবে।’

জিডিতে আরও উল্লেখ করা হয়, শাহাদাতকে হুমকি দিয়ে তরুণী বলেন, ‘বড় বড় মানুষকে নিয়ে এমনভাবে তোর রেকর্ড বানামু, তুই সারা জীবন চাইলেও প্রমাণ করতে পারবি না। তোর জীবন এইখানেই শেষ করমু। তুই কারও কাছে চেহারা দেখাইতে পারবি না। তোর আশপাশের মানুষ যাতে তোর কাছে না ভিড়ে সেই ব্যবস্থা করমু।’ ওই তরুণী বিভিন্ন ছবি এডিট করে শাহাদাতের পরিবারের কাছে পাঠানোর হুমকি দেন বলেও জিডিতে বলা হয়েছে।

ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে তরুণীর অভিযোগ
ফুয়াদ হাসান শাহদাতের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর অভিযোগ করেন তানজিয়া আক্তার লাবণ্য। অভিযোগে তিনি লিখেন, ‘ফুয়াদ হাসান শাহাদাতের সঙ্গে আমার দীর্ঘ ১০ বছরের সম্পর্কে ঘটে যাওয়া অন্যায় নিয়ে আমি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে অবহিত করি। তিনি আপনাদের (ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) মীমাংসা করার দায়িত্ব দেওয়ার পর আমি শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি গত ৫ এপ্রিল মীমাংসা করতে বসার সময় নির্ধারণ করেন। কিন্তু ৩ এপ্রিল শাহাদাত আমাকে অনেক অনুরোধ করে তার বাসায় ডেকে নেন পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সমাধান করার জন্য। কিন্তু তিনি তা না করে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি লাথি মারেন এবং মারাত্মকভাবে জখম করেন। উপায় না পেয়ে আমি ৯৯৯-এ কল করি এবং পুলিশ এসে আমাকে উদ্ধার করে। ঘটনার সময় আমি শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ভাইকেও অবহিত করি। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। এ ঘটনায় আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। আমি সামাজিকভাবে স্বীকৃতি চাওয়ার পর থেকেই শাহাদাত আমার পরিবারের সবার বিরুদ্ধে মামলা এবং বিভিন্নভাবে ক্ষতি করার হুমকি দেন। এমনকি আমাকের প্রাণনাশের হুমকি দেন। তার এসব কার্যকলাপে আমি আতঙ্কিত।’

এ অভিযোগে লাবণ্য উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালে মুসলিম রীতি অনুসারে আমাদের বিয়ে হয় এবং বিয়ের সব ডকুমেন্ট শাহাদাত নিজের কাছে আটকে রাখেন। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি অস্বীকার করেন শাহাদাত।

শাহাদাতের বিরুদ্ধে থানায় জিডি
গত ২৬ মে রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন লাবণ্য। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, ফুয়াদ হাসান শাহাদাতের সঙ্গে ২০১৬ সালে তার বিয়ে হয়। তাদের মধ্যে পারিবারিক কলহের পর গত ১৮ মে রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপে কল করে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। একই সঙ্গে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জিডির তদন্ত কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. শাহাব উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তাধীন বিষয়ে কথা বলতে পারবো না। বিষয়টি যেহেতু সাইবার রিলেটেড সেহেতু সাইবার ইউনিটের সহায়তা নিয়ে কাজ করবো।’

জোর করে গর্ভপাতের অভিযোগ
শুধু বিয়ে নয়, ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাতের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক গর্ভপাতের অভিযোগ তোলেন লাবণ্য। এমন অভিযোগ তুলে শাহাদাতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ পাঠান। ওই মেসেজে তিনি শাহাদাতের সঙ্গে দীর্ঘদিন একই বাসায় একসঙ্গে থেকেছেন বলে উল্লেখ করেন। ২০১৯ সালে তিনি সন্তানসম্ভবা হলে শাহাদাত জোর করে তার গর্ভপাত করান বলে অভিযোগ করেন।

তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পাঠানো মেসেজে তিনি শাহাদাতের সঙ্গে তার বিয়ের বিষয় উল্লেখ করেননি। অন্যদিকে হাজারীবাগ থানায় করা জিডি ও ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কাছে দেওয়া অভিযোগে বিয়ের কথা উল্লেখ করলেও গর্ভপাতের বিষয় উল্লেখ করেননি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক এ ছাত্রলীগ নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেন জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক। তিনি বলেন, ‘তার (শাহাদাতের) সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে ২০১৬ সালে কক্সবাজারে। আমরা দীর্ঘদিন ঢাকায় একই বাসায় ছিলাম। এখন শাহাদাত এসব অস্বীকার করছেন।’

বিয়ের কাবিননামার বিষয়ে জানতে চাইলে লাবণ্য বলেন, ‘কাবিননামা আমার কাছে নেই। শাহাদাত আটকে রেখেছেন। যে কাজী বিয়ে পড়িয়েছেন তাকেও চিনি না। যারা সাক্ষী ছিলেন তাদেরকেও চিনি না। শাহাদাত এখন আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। আমি সামাজিক মর্যাদা (বিয়ের স্বীকৃতি) চাই।’

লাবণ্য অভিযোগ করেন, গত ৩ এপ্রিল শাহাদাতের বাসায় গেলে তার ওপর হামলা চালানো হয়। এসময় তিনি ৯৯৯-এ কল দিয়ে পুলিশের সাহায্য চান।

তবে শাহাদাতের অভিযোগ, লাবণ্য তার বাসায় ঢুকে ভাঙচুর চালান। এসময় তারা ৯৯৯-এ কল করে পুলিশের সাহায্য চান।

দুজনের দাবির সত্যতা যাচাইয়ে তাদের কাছে ৯৯৯-এ কল পরবর্তী ফিরতি সিএফএস নম্বর চান এ প্রতিবেদক। দুইজন তাদের মোবাইল ফোনে থাকা মেসেজের (সিএফএস) স্ক্রিনশট জাগো নিউজের এই প্রতিবেদককে পাঠান।

শাহাদাতের বাসায় ঘটে যাওয়া ঘটনার কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ জাগো নিউজের হাতে এসেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, লাবণ্য রুমে এলোমেলো চলাফেরা করছেন এবং ফোনে কথা বলছেন। এতে শাহাদাতকে বলতে শোনা যায়, লাবণ্য তার বাসায় চুরি করতে ঢুকেছেন এবং বাসায় থাকা দুইটি মোবাইল ফোন ভেঙেছেন। ভিডিওতে ভেঙে যাওয়া মোবাইল ফোন প্রদর্শন করতে দেখা যায়।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট কয়েকজন সাংবাদিকসহ পরিচিতজনদের পাঠিয়েছেন লাবণ্য। তবে ওই রিপোর্টে রোগীর নাম লেখা রয়েছে সামান্তা রহমান। সামান্তার গর্ভে সন্তান রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। এতে স্বামীর নামের পাশে ফুয়াদ হোসেন শাহাদাতের নাম লেখা।

অভিযোগ রয়েছে, লাবণ্য এই রিপোর্ট বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে নিজেকে সন্তানসম্ভবা দাবি করেন এবং জোর করে গর্ভপাত করানো হয়েছে বলে প্রচার করেন।

তবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাবণ্যর দেওয়া রিপোর্টের সঙ্গে এ হাসপাতাল থেকে দেওয়া অন্যান্য রিপোর্টের ফরম্যাটে পার্থক্য রয়েছে। এ হাসপাতাল থেকে দেওয়া আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে অভিভাভক বা স্বামীর নাম এবং ফোন নম্বর দেওয়া থাকে না। এছাড়া হাসপাতাল থেকে দেওয়া কোনো রিপোর্টে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপক সই করলে তার নাম উল্লেখ থাকে। অথচ লাবণ্যর রিপোর্টে চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করা নেই।

এ বিষয়ে লাবণ্যর কাছে জানতে চাইলে সুর পাল্টে বলেন, ‘এটি আমার রিপোর্ট না। শাহাদাত নিজেই এ রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন ওই মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। মূলত আমাকে দূরে সরিয়ে দিতেই তিনি এগুলো করেছেন।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত বলেন, ‘লাবণ্য নিজেই এসব ভুয়া কাগজ তৈরি করে আমার সম্মানহানী করছেন। এখন ধরা পড়ার পর মিথ্যা বলছেন যে এই রিপোর্ট আমি তাকে পাঠিয়েছি।’

এসময় লাবণ্যর সঙ্গে পরিচয়ের বিষয় জানতে চান এ প্রতিবেদক। শাহাদাত বলেন, ‘লাবণ্যর সঙ্গে পরিচয় ছিল। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছে। এখন অন্য কারও প্ররোচণায় তিনি আমার ক্যারিয়ার শেষ করতে চাইছেন। মান-সম্মানের ভয়ে তাকে বলেছি কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে হলেও আমাকে যেন আর বিরক্ত না করেন। তিনি চাইছেন তার নামে যেন ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে দেই। এত টাকা আমি কোথায় পাবো!’

লাবণ্যকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না জানিয়ে ছাত্রলীগের এ নেতা বলেন, ‘সব মিথ্য বলছেন। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি তিনি বিয়ের কোনো ডকুমেন্টস দেখাতে পারবেন না। উল্টো মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে আমার সম্মান নষ্ট করছেন। আমি তার নামে মানহানির মামলা করবো।’

এনএস/কেএসআর/জেআইএম

Read Entire Article