স্ত্রীর সামনে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে হত্যা, মামলা নিয়ে সংশয়ে পরিবার

11 hours ago 6

‘অনেক সুখেই ছিলাম আমরা। বাবার আয় দিয়ে সংসার চলত। বাবারে কুপাইয়া মাইরা ফালানোর পর থিকা বিপদে পড়ে গেছি। কয়েকদিন ধরে বাজার-সদাই করতে পারি না। আত্মীয়স্বজন বাজার করে দেন। আজও দিছে। আসামি ছয়জনকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। এখন আদালতে যেতে হয়। উকিলকে টাকা দিতে হয়। সব মিলাইয়া বিপদে পড়ে গেছি। মামলা চালাইতে পারুম কিনা বুঝতেছি না।’ 

আক্ষেপের সুরে এভাবেই কথাগুলো বলেন, গত ৯ মার্চ সাভারের নয়ারহাট বাজারে ডাকাতদের হামলায় নিহত স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলীপ দাসের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে দীপ দাস। দীপ দাস গোকুলনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত দীপ দাস। পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পড়াশোনার পাশাপাশি স্থানীয় একটি শপিংমলে কাজ নেওয়ার।

দীপ দাস কালবেলাকে বলে, ‘আমাদের তো এতো টাকা নাই। বাবা মারা যাওয়ার পর এখন সমস্যায় পড়ে গেছি। দোকান ভাড়া নেওয়ার সময় কিছু টাকা অগ্রিম দেওয়া ছিল। সেই টাকাগুলো ফিরিয়ে দিলে সেগুলো আর ৪ শতাংশের একটি জমি আছে, সেটি বিক্রি করে আমার পড়াশোনা আর পরিবার চালানো হবে। সিদ্ধান্ত নিছি একটি মার্কেটের দোকানে কাজ নেব। কথাবার্তাও হইছে। মামলা চালাইতেও টাকা লাগতেছে। মামলা মনে হয় চালাইতে পারব না। স্বামীকে হারিয়ে দুই ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত দিলীপ দাসের স্ত্রী সরস্বতী দাস। সামনের দিনগুলি তার কাছে অন্ধকারে ঢাকা।’

সরস্বতী দাস কালবেলাকে বলেন, ‘দুই ছেলে পড়াশোনা করে। পরিবারের খরচ, তাদের পড়াশোনার খরচ চালাব কীভাবে। বড় ছেলের ওপর এখন সব দায়দায়িত্ব। সেও ছোট। সে ছাড়া তো আর কেউ নাই। স্বর্ণ ও টাকা যা উদ্ধার হইছে, সেগুলোও পুলিশের কাছে। কিছুই নাই আমাদের কাছে। আত্মীয়স্বজনরা বাজার করে দেয়। সেগুলো দিয়ে চলতেছি। আমাদের পাশে যদি কেউ না দাঁড়ায় তাইলে আমরা আরও বিপদে পড়ে যাব।’

গত ৯ মার্চ রাতে আশুলিয়ার নয়ারহাট বাজারে ককটেল ফাটিয়ে স্ত্রীর সামনেই স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলীপ দাসকে কুপিয়ে হত্যার পর স্বর্ণের ব্যাগ লুট করে প্রাইভেটকারে পালিয়ে যায় ৮-১০ জনের একটি ডাকাতদল। পরে ওই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী সরস্বতী দাস বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ১০ মার্চ রাতে রাজশাহী, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ৬ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয় লুণ্ঠিত ১৩ ভরি স্বর্ণালংকারসহ ৭৬ হাজার টাকা।

স্ত্রীর সামনে দিলীপ দাসকে বাজারে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় বাজারের অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। শোক আর আতঙ্কের মধ্যে ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল দিলীপের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা। ঘটনার ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি।

নয়ারহাট বাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আশুতোষ ঘোষ কালবেলাকে বলেন, ওইদিনের ঘটনার পর থেকে আমরা আতঙ্কের মধ্য দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যার পরপরই আমরা দোকান বন্ধ করে দিই। সন্ধ্যার পর কোনো কাস্টমার বাজারে আসে না বললেই চলে। দিলীপ দাসের খুনিদের ধরা হয়েছে। এতে আমরা সন্তুষ্ট। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। খুনিরা একটা পরিবার শেষ করে দিছে। আমরা লাশ নিয়ে মিছিল করেছিলাম সবার নিরাপত্তা ও একটি পুলিশ ফাঁড়ি এখানে স্থাপনের জন্য। কিন্তু সেটি এখনো করা হয়নি। সরকারের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া, আমাদের নিরাপত্তা যেন দেওয়া হয়। 

বাজারের আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন কালবেলাকে বলেন, ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এই বাজারে ১৭টি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই সময় প্রায় দেড় কোটি টাকার মালপত্র লুট করে নিয়ে গিয়েছিল ডাকাতরা। এরপর বাজারে আর তেমন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। সম্প্রতি দিলীপ দাসকে কুপিয়ে হত্যা করে স্বর্ণ লুটের ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত।

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহীনুর কবির কালবেলাকে বলেন, নয়ারহাট বাজার এলাকায় এরই মধ্যে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। সেখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দিলীপ দাসের হত্যার ঘটনায় অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের এরই মধ্যে রিমান্ডে এনে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

Read Entire Article