পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে রাজধানীতে গিয়ে ফার্নিচার মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করছিলেন কামরুল মিয়া। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে কাজ ফেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অংশ নেন তিনিও। সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার দেহ।
পরিবারের একমাত্র ভরসা ছিল কামরুল। পরিবার নিয়ে তার ছিল অনেক স্বপ্ন। গত একবছরে পরিবারের স্বপ্ন পূরণ হলেও নেই শুধু কামরুল। ছেলের কথা মনে হতেই নির্বাক হয়ে যান বাবা। ছবি হাতে নিয়ে খুঁজে বেড়ান ছেলেকে।
কামরুল মিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার গৌরনগর গ্রামের নান্নু মিয়ার ছেলে।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিল কামরুল। বাবা কৃষি কাজ করেন। মা ব্রেইন টিউমারে মারা গেছেন ৭ বছর আগে। এর তিন বছর পর ক্যান্সারে বড় ভাই মারা যান। চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে জমিজমা বিক্রি করে বাবা পড়ে যান অর্থ সমস্যায়। মেঝ ভাই টাইলসের কাজ করে টুকটাক আয় করতেন ও সবার ছোট ভাইয়ের বয়স মাত্র ১৩ বছর। কামরুল ছিলেন মাদরাসার ছাত্র। চার বোনের মধ্যে দুই বোনকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক বোনের বিয়ে বাকি ছিল। ছোট বোনটি ছিল তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।
মেঝ ভাইয়ের আয় দিয়ে পরিবার চলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই করুন দশায় কামরুলের ইচ্ছে ছিল পরিবারের হাল নিজেই ধরবেন। তার স্বপ্ন ছিল নিজে প্রবাসে পাড়ি দেবেন, বাড়ির ভাঙা ঘর বাদ দিয়ে নতুন করে তুলবেন ও বোনকে বিয়ে দিবেন। সেই স্বপ্ন থেকে কামরুল পরিবারের হাল ধরতে দুই বছরে আগে বাবার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় পাড়ি দেন। রাজধানীতে গিয়ে ফার্নিচারের কাজ শেখা শুরু করেন। পরে কাঠ মিস্ত্রীর কাজে যোগদান করেন। সেখান থেকে প্রতিমাসে বাবাকে টাকা পাঠাতেন সংসার চালাতে। মূলত তার টাকা দিয়েই সংসার চলতো।
এরই মাঝে প্রবাসে পাড়ি দিতে কামরুল পাসপোর্ট করেছিলেন। চেষ্টা ছিল প্রবাসে গিয়ে পরিবারের হাল ধরার। কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হয়নি কামরুলের। চব্বিশের ২০ জুলাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন কামরুল। কামরুলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী গেল মাত্র কয়েকদিন আগে।
কামরুল শহীদ হওয়ার পর সরকারি ও রাজনৈতিক দলের অর্থনৈতিক সহযোগিতা পায় তার পরিবার। সেই অর্থে তার বাড়ির উঠানে উঠেছে রঙিন টিনের রঙিন ঘর, বিয়ে দেওয়া হয়েছে তার বোনকে। কামরুল যেতে না পারলেও তার মেঝ ভাই পাড়ি দিয়েছেন সৌদি আরবে। স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, শুধু বেঁচে নেই কামরুল।
বাবা নান্নু মিয়া ভুলতে পারেননি তার হারানো বুকের ধন কামরুলকে। বিচার দেখে যেতে চান ছেলের হত্যাকারীদের।
কামরুলের বাবা নান্নু মিয়া বলেন, আমার ছেলে কামরুল পরিবারের হাল ধরতে ঢাকায় গিয়েছিল। তার অনেক স্বপ্ন ছিল পরিবার নিয়ে। তার স্বপ্ন সব পূরণ হচ্ছে কিন্তু আমার ছেলেতো নেই।
তিনি বলেন, এই দেশের জন্যে আমার ছেলেসহ হাজারো ছেলে প্রাণ দিয়েছে। আমরা চাই দেশটা সুন্দরভাবে চলুক। দেশ যতদিন থাকবে আমার ছেলের নাম যেন সবসময় থাকে। আমার ছেলের হত্যার কঠিন বিচার চাই।
তিনি আরও জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ ও জামায়াতে ইসলামী থেকে দুই লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছিলাম। এই সহায়তায় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে ভাঙা ঘরের স্থলে নতুন টিনের ঘর উঠিয়েছি।
কামরুলের ছোট ভাই হামিম বলেন, আমি মাদরাসায় পড়ি। ভাই যখন বাড়িতে আসতেন আমার জন্যে মজার খাবার নিয়ে আসতেন। মাদরাসায় গিয়ে খোঁজখবর নিতেন। আমাকে পড়াশোনা ভালোভাবে করতে বলতেন। যাওয়ার সময় আমাকে টাকা দিয়ে যেতেন কিছু কিনে খেতে। ভাই নেই, এখন সেই আদর আর কেউ করে না।
কামরুলের চাচা আলমগীর মিয়া বলেন, কামরুল ঢাকায় ছিল জীবিকার তাগিদে। কিন্তু আন্দোলনে সেই জীবিকা ফেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিদিনই মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে। দেশের জন্যে সে প্রাণ দিয়েছে। আমাদের দাবি, তার পরিবারের পাশে সবসময় সরকার থাকুক।
স্থানীয় বাজারের মুদি দোকানি সাইফুর রহমান বলেন, কামরুল অমায়িক একটি ছেলে ছিল। সে বাড়িতে এলে আমার দোকানে আসতো। স্থানীয়দের সবার খোঁজ খবর নিতো। পরিবারের প্রতি ছিল অনেক দরদ। যাওয়ার সময় বলে যেতো, তার বাড়ির দিকে যেন আমরা খেয়াল রাখি।
এমএন/জিকেএস