রাজশাহীর হোসনিগঞ্জ একসময় ছিল বেত শিল্পের জন্য সুপরিচিত। স্বাধীনতার আগেই এখানে গড়ে উঠেছিল ‘বেত পট্টি’। সেই সময়ে ১৫ থেকে ২০টি দোকানে তৈরি হতো দৃষ্টিনন্দন সব বেতের সামগ্রী। ঘর সাজানোর সৌখিন জিনিস থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাব সবই মিলত এই বাজারে।
তখনকার দিনে সিলেট থেকে আগত দক্ষ কারিগররা রাজশাহীতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাদের হাতের কাজ ছিল অসাধারণ। রাজশাহীর মানুষ সেই প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন, এবং ধীরে ধীরে নিজেরাও বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে এই শিল্পই হয়ে ওঠে এ শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। রাজশাহীর নববধূরা বিয়ের সময় উপহার হিসেবে বেতের তৈরি ট্রে, ঝুড়ি বা চেয়ার পেতেন। এটি তখন এক ধরনের সামাজিক মর্যাদা হিসেবেও বিবেচিত হতো।
কিন্তু আজ আর সেই দিন নেই। একসময়ের জমজমাট বেত পট্টি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আছে কেবল তিনটি মাত্র দোকান। হারিয়ে গেছে সেই কর্মচাঞ্চল্য, সেই উৎসবমুখর পরিবেশ।
দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন কর্মচারী মো. লিটন শেখ। তিনি বলেন, ‘আগে এখানে ১৫-২০টা দোকান ছিল, এখন আছে মাত্র তিনটা। একটা জিনিস যদি ৩০০ টাকায় তৈরি হয়, বাজারে তার চেয়ে অনেক কম দামে সিনথেটিক পণ্য পাওয়া যায়। ফলে মানুষ বেতের জিনিস কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছে। সৌখিনতার কারণে কেউ কিনলেও সেটা এখন ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। রাসায়নিকের তৈরি এসব পণ্য আমাদের শিল্পকে মার খাইয়ে দিচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, ‘শুধু সিনথেটিকের পণ্য নয়, জায়গার সংকটও বড় চ্যালেঞ্জ। আশপাশে একের পর এক কোচিং সেন্টার ও বহুতল ভবন গড়ে ওঠায় মালিকরা দোকান ভাড়া দিতে অনাগ্রহী। অনেক পুরোনো ভাড়াটিয়াদের অন্য কোথাও চলে যেতে বলা হয়েছে। মজুরি কম হওয়ায় দক্ষ কারিগররা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। একসময় যেখানে ৫০-৬০ জন কারিগর কাজ করতেন, এখন তিনটি দোকান মিলিয়েও পাঁচজন নেই।’
হোসনিগঞ্জের একসময়ের বড় মহাজন মোহাম্মদ আলী জানান, ‘আগে আমার দোকানে দশজনের বেশি কারিগর কাজ করতেন। এখন আছে মাত্র তিনজন। কারিগররা বেশি মজুরি দাবি করে, কিন্তু বাজারে বেতের চাহিদা কমে যাওয়ায় সেটা দেওয়া সম্ভব হয় না। পরিশ্রম করে পণ্য বানাতে গিয়ে যে দাম দাঁড়ায়, মানুষ তা মেনে নিতে চায় না। একসময় উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল, এখন শুধু টিকে থাকার চেষ্টা করছি। কতদিন পারব, বলা কঠিন।’
কারিগর সোহাগের বক্তব্যে উঠে আসে কাঁচামালের সংকটের বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘বাঁশ এখন সহজে পাওয়া যায় না। চট্টগ্রাম-সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আনতে হয়। সময়মতো সরবরাহ হয় না। বর্ষাকালে কাদায় আসবাব নষ্ট হয়। আবার চারপাশে যেভাবে বহুতল ভবন হচ্ছে, তাতে যদি ডেভেলপাররা জায়গা দখল করে নেয়, তাহলে এই তিনটি দোকানও টিকবে না। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো পথ নেই।’
কারিগরদের মতে, দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে এই শিল্পে টিকে থাকা সম্ভব নয়। একই সময়ে নিরাপত্তাকর্মী বা অটোরিকশা চালিয়েও এর চেয়ে বেশি আয় করা যায়। ফলে অনেকে পেশা পরিবর্তন করছেন। একসময় যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কারিগররা পারিবারিকভাবে এ শিল্পে যুক্ত থাকতেন, এখন সেই ধারাও ভেঙে যাচ্ছে। সন্তানরা আর বাবার পেশা গ্রহণে আগ্রহী নয়।
তবে এই বেত শিল্পের এক বিশেষ দিক হলো এর পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্য। বেতের সামগ্রী শতভাগ প্রাকৃতিক ও জীবাণুমুক্ত। টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। স্থানীয়দের মতে, পর্যটন খাতের সঙ্গে যুক্ত করলে এবং আধুনিক ডিজাইনের সঙ্গে ঐতিহ্য মিশিয়ে নতুনভাবে বাজারজাত করলে এখনো এই শিল্পকে ঘুরে দাঁড় করানো সম্ভব।
এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহজ শর্তে ঋণ, কারিগরদের প্রশিক্ষণ এবং বাজার সম্প্রসারণে উদ্যোগ। বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলা ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে হোসনিগঞ্জের বেত পণ্য স্থান পেলে আবারো ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়তে পারে। পাশাপাশি অনলাইনে বিপণন ব্যবস্থাও বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
রাজশাহীর হোসনিগঞ্জের বেত পট্টি একসময় ছিল শিল্প-সৃজন আর বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। আজ সেটি ধুঁকছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে। বিকল্প সস্তা পণ্য, কাঁচামালের সংকট, কারিগরদের অনাগ্রহ এবং জায়গা হারানোর শঙ্কা সব মিলিয়ে ঐতিহ্যের এই শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
যদি যথাসময়ে সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে হোসনিগঞ্জের বেত শিল্প একদিন কেবলই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে। হারিয়ে যাবে সেই সৃজনশীল হাতের কাজ, হারিয়ে যাবে রাজশাহীর একসময়ের ঐতিহ্যবাহী গর্ব।
আরও পড়ুন
অমীমাংসিত ৫ রহস্য, যার ব্যাখ্যা মেলেনি আজও
২১ নাকি ২২ ক্যারেট সোনা ভালো, আসল নকল চিনবেন যেভাবে
কেএসকে/জিকেএস