অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতির পাশাপাশি চ্যালেঞ্জিং ও আলোচিত খাতগুলোর একটি ছিল স্বাস্থ্য। গত এক বছরে নানান সংকট, দুর্নীতি, অনিয়ম, জনবল সংকটের পরও এ খাতে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ-আহতদের তালিকা প্রণয়ন, চিকিৎসা, পুনর্বাসন, ওষুধ উৎপাদন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, জনবল নিয়োগ-পদোন্নতি ও ডিজিটাল রূপান্তরে এসেছে পরিবর্তন। তবে জুলাই আহতদের তালিকা কিংবা চিকিৎসা নিয়ে কিছু সমালোচনাও রয়েছে।
জুলাই শহীদ-আহতদের তালিকা করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের নির্ভরযোগ্য তালিকা তৈরি ছিল একটি বড় প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা না হওয়ার বাস্তবতা সামনে রেখে সরকার প্রাথমিকভাবে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে।
এই কমিটির মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আহতদের তালিকা সংগ্রহ করা হয় এবং জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়। এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮১১ জন আহত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২ হাজার ৪২ জনের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে। www.medical-info.dghs.gov.bd ওয়েবসাইটে এসব তথ্য এখন উন্মুক্ত।
চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বহুমুখী উদ্যোগ
আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিতে বিনামূল্যে সেবা চালু করা হয় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। চিকিৎসক বোর্ডের সুপারিশে ৭৮ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে (সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক) পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্সসহ আটটি দেশ থেকে ২৬ জন বিদেশি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এনে স্থানীয়ভাবে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়।
আমরা বলছি না, সব করে ফেলেছি। প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো পুরোপুরি কাজ করতে পারিনি। তবে আমরা সচেষ্ট। আন্তরিকতার সঙ্গে টিম ওয়ার্ক করছি। আশা করি, সফল হবো।- স্বাস্থ্যসেবা সচিব মো. সাইদুর রহমান
আহতদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ঢাকার ধামরাইয়ের কৃষ্ণনগরে একটি পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জন্য রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগী সেবা পাবে। ইতোমধ্যে ২৭ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, আরও প্রশিক্ষণ চলমান। এছাড়া আহতদের মধ্যে যারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, তাদের জন্য কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যকার্ড ও আজীবন সেবার ব্যবস্থা
গেজেটভুক্ত আহত ১২ হাজার ৪২ জনের মধ্যে ৭ হাজার ৩৬৩ জনকে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যকার্ড দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা আজীবন বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসা পাবেন। এই কার্ডধারীরা চিকিৎসাসেবা গ্রহণে অগ্রাধিকার পাবেন।
ওষুধ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের ওষুধ ও ভ্যাকসিন উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনে ইডিসিএলের (EDCL) সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে ইডিসিএল ১৫ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করে, কিন্তু নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা বাড়িয়ে ৮০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
- আরও পড়ুন
- নির্দলীয়, সৎ ও দক্ষ লোক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে
- ৬৫ চিকিৎসকের নিয়োগ বাতিল, ফেঁসে যাচ্ছে পরিচালনা বোর্ড
- সরকারি টাকায় কেনা ওষুধে ‘বেসরকারি মোড়ক’
- ৬০০ কোটি টাকার হাসপাতাল এখন জুলাই আহতদের ‘আবাসিক হোটেল’
গোপালগঞ্জে থাকা ভ্যাকসিন প্ল্যান্টের কার্যকারিতা কম হওয়ায় সেটিকে সরিয়ে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে স্থানান্তর করা হচ্ছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় নতুন প্ল্যান্টের কাজ শুরু হয়েছে।
বদলি ও পদায়নে ডিজিটাইজেশন
চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বদলি ও পদায়নে ঘুস-দুর্নীতি এবং লেনদেনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তা রোধে মন্ত্রণালয় চালু করেছে ডিজিটাল বদলি ও পদায়ন ব্যবস্থা। নার্সদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৫০০ পদায়ন সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি চালুর কাজ চলছে। এডিবির অর্থায়নে স্বাস্থ্যখাতের পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল রূপান্তর প্রকল্প পাঠানো হয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে।
চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অগ্রগতি
২০২৪-২৫ অর্থবছরে চিকিৎসক সংকট দূর করতে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩ হাজার চিকিৎসকের নিয়োগ পরীক্ষা শেষ, পদায়ন প্রক্রিয়াধীন। ৪৫তম, ৪৬তম, ৪৭তম বিসিএসের মাধ্যমে আরও সাড়ে তিন হাজার জন নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। ৩ হাজার ৫১২ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পেয়েছেন, পদায়নের অপেক্ষায়। ৫ হাজার নার্স ও ৪ হাজার মিডওয়াইফের পদ সৃষ্টি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়ে।
যেখানে হাত দেই সেখানেই সমস্যা। অরাজকতা। তারপরও কোথাও চাপ দিয়ে কোথাও বুঝিয়ে কনভিন্স করে কাজ করছি। সব করে দিয়ে যেতে না পারলেও একটা দৃশ্যমান সংস্কার করছি। শিগগরি এর সুফল ভোগ করবে জনগণ।-স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম
পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বড় অগ্রগতি হয়েছে— ২১৮ জনকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। জুনিয়র ও সিনিয়র কনসালট্যান্টসহ প্রায় ৭ হাজার চিকিৎসককে ‘সুপার নিউমারারি’ পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলমান।
সরকারি হাসপাতালে দুই শিফটে সেবা
জনগণের চিকিৎসাসেবা দীর্ঘ সময় নিশ্চিত করতে ঢাকাসহ অন্য বড় শহরে দ্বিতীয় শিফট চালু করা হয়েছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল এখন রাত ৮টা পর্যন্ত চালু থাকছে। পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া এ কর্মসূচি সফল হলে দেশের অন্য হাসপাতালেও চালু করা হবে।
আইনি সংস্কার ও আধুনিক স্বাস্থ্যনীতির উদ্যোগ
স্বাস্থ্যখাতে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ আইনে রূপ নিতে যাচ্ছে। এতে কিডনি ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট সহজ হবে, চিকিৎসাব্যয় কমবে। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট নিয়েও প্রস্তুতি চলছে।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ চিকিৎসা শিক্ষা অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের প্রস্তুতি চলছে।
স্বাস্থ্য অবকাঠামো: নতুন হাসপাতাল নির্মাণ
চিকিৎসার সুযোগ আরও সম্প্রসারণে নতুন বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। রংপুরে এক হাজার শয্যার হাসপাতাল (চীনের অনুদানে) হবে। ঢাকা উত্তর সিটি ও চট্টগ্রামে ৫০০-৭০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণাধীন। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং কাউন্সিল, বিএমডিসি ও বিএমআরসিকে পুনর্গঠন করে গবেষণা ও নীতিনির্ধারণেও গতি আনা হয়েছে।
নীরব অগ্রগতি, কাঠামোগত সংস্কার
প্রচারের বাইরে থেকে হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত এক বছরে নানামুখী ও বাস্তবভিত্তিক সংস্কার কার্যক্রম চালিয়েছে। আহতদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা সহজপ্রাপ্য করা, ওষুধ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, ডিজিটাল পদায়ন, বিশাল নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে একটি সংকটাপন্ন খাত আজ অনেকটাই সুসংহত হয়ে উঠেছে।
সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ
গত এক বছরে স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতি যেমন দৃশ্যমান, তেমনি কিছু বিষয়ে সমালোচনাও উঠেছে। আহতদের তালিকা তৈরিতে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত আহতরা বাদ পড়লেও রাজনৈতিকভাবে কাছের অনেকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। সরকারি হাসপাতালে সেবার মান, ওষুধ ঘাটতি ও হয়রানি—পুরোনো সংকট এখনো কাটেনি। লাইসেন্সহীন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু থাকলেও নজরদারি দুর্বল।
পদায়নে অনিয়ম ও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ থাকায় আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য বাজেটের অধিকাংশই চলে যাচ্ছে নগরকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে, গ্রামীণ ও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা এখনো উপেক্ষিত। ট্রান্সপ্ল্যান্ট নীতি ও আইন বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা গেছে, ফলে দেশের মধ্যে উন্নত চিকিৎসা সক্ষমতা গড়ে তোলা ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া ওষুধের গুণমান ও মূল্য নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মহল।
স্বাস্থ্যসেবা সচিব মো. সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বলছি না, সব করে ফেলেছি। প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো পুরোপুরি কাজ করতে পারিনি। তবে আমরা সচেষ্ট। আন্তরিকতার সঙ্গে টিম ওয়ার্ক করছি। আশা করি, সফল হবো।’
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বলেন, ‘যেখানে হাত দেই সেখানেই সমস্যা। অরাজকতা। তারপরও কোথাও চাপ দিয়ে কোথাও বুঝিয়ে কনভিন্স করে কাজ করছি। সব করে দিয়ে যেতে না পারলেও একটা দৃশ্যমান সংস্কার করছি। শিগগরি এর সুফল ভোগ করবে জনগণ।’
এসইউজে/এএসএ/এএসএম