অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে স্বাস্থ্যখাতের সাফল্য, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাজধানীর শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বক্তব্য দেন। এসময় মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তা ও উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আন্দোলনের আহতদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই নূরজাহান বেগম জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, এই শহীদদের ত্যাগেই আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
২০২৪ সালের আগস্টে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। যার মাধ্যমে ১৪ হাজারের বেশি আহতদের তালিকা তৈরি এবং যাচাই-বাছাই করে ১২ হাজার ৪২ জনকে সরকারি গেজেটভুক্ত করা হয়। এদের সবাইকে সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত ৭৮ জন আহতকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। আরও অনেকের বিদেশে চিকিৎসার প্রক্রিয়া চলমান।
আন্তর্জাতিক সহায়তায় চিকিৎসা ও কর্ণিয়া ট্রান্সপ্লান্ট
বিশ্বের সাতটি দেশ থেকে ২৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশে এসেছেন আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় সহায়তা করতে। ইউকে, নেপাল, চীন, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও থাইল্যান্ডের এই চিকিৎসকরা চোখ, অঙ্গহানি ও স্পাইনাল ইনজুরির মতো জটিল ক্ষেত্রে অপারেশন সম্পন্ন করেছেন।
নেপালের সহায়তায় আনা হয়েছে ৪০টি কর্ণিয়া টিস্যু, যার মধ্যে ইতোমধ্যে ২ জনের কর্ণিয়া ট্রান্সপ্লান্ট সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
রোবটিক ফিজিওথেরাপিতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ
চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়েছে দেশের প্রথম রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার, যেখানে প্রতিদিন ৩০০ রোগী চিকিৎসা নিতে পারবেন। এখানে ৬২টি উন্নত রোবটিক ইউনিট রয়েছে যার মধ্যে ২২টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে পরিচালিত। এই সেবা শুধু আহতদের জন্য নয় বরং ভবিষ্যতে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় পুনর্গঠন ও জনবল নিয়োগ
নূরজাহান বেগম জানান, সরকার স্বাস্থ্যখাতের প্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজিয়েছে। মহাপরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ ও ইনস্টিটিউট পরিচালকের পদায়ন পুনর্গঠন করা হয়েছে। সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে ৭ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৮৬টি বিষয়ে ৮০০ জন চিকিৎসক অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
চিকিৎসক সংকট নিরসনে ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে ৩ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া আরও সাড়ে ৩ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ কার্যক্রমও চলমান।
নার্স, মিডওয়াইফ ও সহায়ক জনবলের নিয়োগ
নূরজাহান বেগম জানান, ৩ হাজার ৫১২ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এবং পদায়ন প্রক্রিয়াধীন। পাশাপাশি ৫ হাজার নার্স ও ৪ হাজার মিডওয়াইফের জন্য পদ সৃষ্টির প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যনীতি ও আইনি সংস্কার
উপদেষ্টা বলেন, স্বাস্থ্যখাতে টেকসই সংস্কার আনতে নতুন আইন ও নীতিমালা অত্যন্ত জরুরি।
তিনি বলেন, ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ উপদেষ্টাসভার অনুমোদন পেরিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে।
- স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন।
- চীনের অনুদানে রংপুরে ১ হাজার শয্যার হাসপাতাল এবং ঢাকা-চট্টগ্রামে বিশেষায়িত হাসপাতাল গঠনের প্রকল্প চলমান।
- এডিবির অর্থায়নে ডিজিটাল হেলথ প্রকল্প, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়নে ‘ওয়ান হেলথ প্রোজেক্ট’ গ্রহণ করা হয়েছে।
দাম কমেছে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের
সরকারের একাধিক কার্যক্রমে চিকিৎসার ব্যয়ও কমেছে।
- হার্টের স্টেন্টের দাম ৩৬ শতাংশ কমানো হয়েছে।
- ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ করা হয়েছে।
- ই-সিগারেট আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনায় জরুরি সেবা
গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে হটলাইন, আউটডোর সাইকিয়াট্রিক সেল ও আউটরিচ প্রোগ্রাম চালু করেছে। ইতিমধ্যে অনেকে সরাসরি ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চিকিৎসায় সহায়তা করছে সিঙ্গাপুর, ভারত, চীন ও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ দল।
নূরজাহান বেগম বলেন, বিপুল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করেছি মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যা করেছি সেটা দায়িত্ববোধ থেকেই।
স্বাস্থ্যখাতের চলমান রূপান্তর এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ বলেও জানান তিনি।
এসইউজে/এনএইচআর/জেআইএম