জীবন পাল
শিল্পের প্রতি ভালোবাসা একথা বললে কিছুটা কম বলা হবে। শিল্প হলো জীবনের আরেক নাম। এ কথাই বিশ্বাস করেন সিলেটের জৈন্তাপুরের মোস্তাফিজুর রহমান সুমন। একজন প্রাক্তন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, যিনি আজ ক্ষুদ্রাকৃতির স্থাপত্যের মডেল নির্মাণে মগ্ন। তার হাতে নির্মিত মিনিয়েচারের কাজগুলো শুধু একটি শিল্প নয়, এগুলো একটি স্মৃতি, একটি ইতিহাস।
জৈন্তাপুরের মোস্তাফিজুর রহমান সুমন একসময় শিক্ষকতা করতেন। জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেটের জৈন্তাপুরে। পরিবারে মা ছিলেন সহকারী শিক্ষক, বাবা প্রধান শিক্ষক। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি ও শিল্পের প্রতি আগ্রহ ছিল। পেনসিল স্কেচ কিংবা জলরঙে মনের কথা বলতেন একসময়। কিন্তু সময়ের স্রোতে সে আগ্রহ রূপ নেয় এক নতুন অভিযাত্রায়-মিনিয়েচার স্থাপত্য নির্মাণে। কখনো চিন্তা করেননি, একদিন এই আগ্রহের ফলেই তিনি দাঁড়িয়ে থাকবেন বাংলাদেশের ঐতিহ্য ধরে রাখা স্থাপত্যশিল্পীদের মধ্যে।
২০১৯ সালে সুমন শুরু করেন তার মিনিয়েচার শিল্পকর্ম। প্রথম কাজ ছিল সিলেটের জৈন্তা রাজবাড়ি। তখনো কাজটা ছিল নিছক নেশা। করোনা মহামারির সময়ে যখন অফুরান অবসর, তখন ঘরে বসে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে শুরু করেন ছোট ছোট স্থাপনা বানানো। যেগুলো দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি ঐতিহ্যিক উপাদানগুলো ধরে রাখার চেষ্টা।
সিমেন্ট, কাঠ, আর চোখে স্বপ্ন-একটা একটা করে গড়ে তোলেন সিলেটের ঐতিহ্যের প্রতীকগুলো। একে একে তৈরি করেছেন সিলেটের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার ক্ষুদ্রাকৃতি মডেল-আসাম আকৃতির ঘর, ক্বীন ব্রিজ, আলি আমজাদ ঘড়ি, চা-কন্যা, রাস নৃত্য, আর্ট কলেজের মতো স্থাপনাগুলোর মিনিয়েচার।
২০২৩ সালে তার তৈরি একটি মিনিয়েচার মডেল এক ফেসবুক ব্যবহারকারী কিনে নেন ৫ হাজার টাকায়। সেই মুহূর্তে তার মনে এক নতুন ভাবনা জন্ম নেয়। তিনি অনুভব করেন, তার কাজের মূল্যায়ন শুরু হয়েছে এবং এই কাজকে আরও বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। সুমনের কাজের প্রতি আজ আর্ট গ্যালারি থেকে শুরু করে, স্থাপত্যবিদ, এমনকি দেশের বাইরের ক্রেতারও আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই মুহূর্তে মোস্তাফিজুর রহমান সুমন নিজে একাই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন। কাঠামো তৈরি থেকে রং করা-সবকিছু নিজে হাতেই করেন। এভাবেই নিজের কাজ উন্নত করার চেষ্টা করছেন প্রতিদিন। তার চলতি প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে আবু সিনা ছাত্রাবাস, দরগাহ গেট, এমসি কলেজের আসাম আকৃতির স্থাপনা, সারদা হলসহ আরও অনেককিছু।
তিনি জানান, শিল্পের প্রতি মানুষের মূল্যায়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ভালোবাসা এবং উৎসাহই তার কাজ চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। একদিন নিজের শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনী আয়োজন করার স্বপ্নও দেখেন তিনি।
সুমনের এই শিল্প শুধু রং ও কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একধরনের উত্তরাধিকার। যেখানে ইতিহাস, আবেগ আর ভালোবাসা ক্ষুদ্র হলেও গভীরভাবে জীবন্ত থাকে।
শিল্পের প্রতি সুমনের ভালোবাসা কখনো থামেনি। হয়তো তার যাত্রার শুরু ছিল কিছু ছোট কাজ দিয়ে, কিন্তু আজ তার কাজ যেন সিলেটের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সুমন জানেন যতই ছোট হোক না কেন, শিল্পের এক অনন্য প্রভাব থাকে, যা কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে।
কেএসকে/জিকেএস