‘হঠাৎ বিকট আওয়াজ শুনি, তারপর আর কিছু বলতে পারবো না’

1 week ago 17

প্রতিদিনের মতো ভোর ৬টায় কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। তবে কাজে গিয়ে বাসায় আর ফিরতে পারেননি তিনি, ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে। দুর্ঘটনায় তার মুখ, দুই পায়ের উরু ও দুই হাত পুড়ে গেছে। একই সঙ্গে পুড়েছে শ্বাসনালীও।

দগ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করা ৩৯ বছর বয়সী আবুল কাশেমকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছিলেন ছেলে মো. শাহীন। কাশেমের পুরো শরীর সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। গোঙানির মধ্যেই কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বুঝতে না পেরে হতভম্ব শাহীন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের ১২ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন কাশেম চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জাহাজ কাটার সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণে দগ্ধ হন।

কাশেমের ছেলে শাহীন বলেন, হঠাৎ দুপুরে একটি ফোন আসে। জানায়, বাবা দগ্ধ হয়েছেন। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। এর পরপরই এখানে আসি। আমার বাবা প্রায় তিনমাস হলো এস এন করপোরেশন শিপইয়ার্ডে ফিডারম্যান হিসেবে কাজ করেন। সেখানে বিস্ফোরণ কীভাবে হলো- তা এখনো জানতে পারিনি। তিনি কথাও বলতে পারছেন না।

শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের তেঁতুলতলা এলাকার সমুদ্র উপকূলে এসএন করপোরেশন নামে একটি শিপইয়ার্ডে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হন ১২ জন, যাদের মধ্যে ১১ জনেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। গুরুতর অবস্থা ৮ জনের। তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকাতে পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে, দুটি কক্ষে মোট ১২ জন দগ্ধ শ্রমিককে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চারপাশে রোগীদের গোঙানি আর আর্তনাদের শব্দ। বেশিরভাগেরই পুড়ে গেছে শ্বাসনালী। স্বজন-সহকর্মীদের চোখেমুখে ছিল চাপা আতঙ্ক, ছোটাছুটি করছেন এদিক-ওদিক। কেউ হাতপাখা আবার কেউ ছোট বৈদ্যুতিক ফ্যান নিয়ে দগ্ধ ব্যক্তিদের বেডের পাশে দাঁড়ানো।

দগ্ধ আহমেদ উল্লাহর পাশে গিয়ে তার স্ত্রী ভরসা দিয়ে বললেন, আল্লাহ্ সব ঠিক করে দেবেন। এরপরেই নিজের চোখের পানি সামলাতে না পেরে সরে গিয়ে দাঁড়ালেন বারান্দায়। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করে বললেন, ভাই, শুধু দোয়া করেন। এরপর আবারও ভেঙে পড়েন কান্নায়।

১৪ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে ঢাকায়।

ওদিকে খবর পেয়ে গ্রামের বাড়িতে ছটফট করছিলেন আনোয়ারের বৃদ্ধ মা। তার বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার রতনপুর গ্রামে। আনোয়ারকে দেখভাল করছিলেন ছেলে বিল্লাল হোসেন, যিনি একই শিপইয়ার্ডে রাতের শিফটে কাজ করেন।

বিল্লাল হোসেন জানালেন, তার বাবাকে দাদির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। যদিও বাবার কথা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। কথা বলার সময়েও যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিলেন, আর হাউমাউ করছিলেন।

বিল্লাল বলেন, আমি ওই শিপইয়ার্ডে নাইট ডিউটি করি; আর আব্বু দিনে কাজ করেন। আব্বু প্রায় তিনবছর ধরে ওখানে কাজ করেন। ঘটনার আগে আমি বাসায় ছিলাম। শিপইয়ার্ডের একজন ফোন করে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানালে হাসপাতালে ছুটে আসি। এসে দেখি, আব্বুর মাথার চামড়া ও হাঁটু পুড়ে গেছে।

‘যতদূর জানি ২০ থেকে ২৫ বছর আগে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেবার একজন দগ্ধ হয়েছিলেন, যিনি এখনো এসএন করপোরেশনে কাজ করছেন। আমার জানামতে, আব্বু যে জাহাজে কাজ করেন, ওটা তেলের জাহাজ। আমিও আগে সেটিতে করেছিলাম।’

শোয়া থেকে উঠে বসে ১১ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন শিপইয়ার্ডের নিরাপত্তা পরিদর্শক আল আমিন বারবার হাউ হাউ করে গোঙাচ্ছিলেন। বলেন, হঠাৎ বিকট আওয়াজ শুনলাম এরপর আর কিছু বলতে পারি না।

দগ্ধ আল আমিনকে পানি পান করাচ্ছেন তারই এক সহকর্মী ইমরান। আল আমিন শিপ ইয়ার্ডের নিরাপত্তা পরিদর্শক পদে কর্মরত।

ইমরান জানান, জাহাজ কাটার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অদূরে অন্য কাজ করছিলেন তিনি। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান ও ছুটে গিয়ে দেখেন, অনেকে দগ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছেন।

৯ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন ছিলেন মো. রফিক। তিনি বিকট শব্দে কানে আঘাত পেয়েছেন। তিনি বলেন, হঠাৎ এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনেক বিকট আওয়াজ হয়েছিল। ডান কানে ভালোভাবে শুনতে পাচ্ছি না।

চমেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মো. রায়হানুল কাদের বলেন, দুপুর ১টা নাগাদ মোট ১২ জন দগ্ধ রোগীকে হাসপাতালে আনা হয়। প্রাইমারি এসেসমেন্ট করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই, সব রোগীরই শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত।

এম মাঈন উদ্দিন/এসএএইচ

Read Entire Article