জুলাই আন্দোলনে হত্যার সরাসরি নির্দেশদাতাদের পাশাপাশি এ নৃশংসতা বন্ধে সরকারের যারা উদ্যোগ নেননি তারা ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বা কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির আওতাভুক্ত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি পেশকালে এ কথা বলেছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
আন্দোলনকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ৪৬তম সাক্ষী হিসেবে মাহমুদুর জবানবন্দি দেন। তিনি এর আগে সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) প্রথম দিনের মতো জবানবন্দি দেন।
মাহমুদুর বলেন, হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার মহান জুলাই বিপ্লবের সময় যে গণহত্যা চালিয়েছে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সে সম্পর্কে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণহত্যা চালাতে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। কামাল প্রতি রাতে তার বাড়িতে কোর কমিটির সভা করতেন। সেখানে পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা থাকতেন। সেই সভায় তারা বিক্ষোভকারী এবং আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্রদের ওপর সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের উপায় নিয়ে আলোচনা করতেন।
এ সম্পাদক ট্রাইব্যুনালে জানান, সেই সভায় অংশগ্রহণকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বরাতে জানান যেন আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যে মিডিয়াতে ঘোষণা করেছিলেন, আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের হত্যা করে লাশ গুমের নির্দেশ দিয়েছেন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশে গণহত্যা চালানো হয়েছে। এ কারণে তাদের প্রত্যেকের ওপর কমান্ড রেসপনসিবিলিটি পড়ে।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রকাশিত মানবাধিকার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সাক্ষী বলেন, সেগুলোতেও হাসিনার শাসন আমলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যে তিনটি ভুয়া নির্বাচন হয়েছিল, সে সম্পর্কেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংসদেও উক্ত তিনটি নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মধ্যে আল জাজিরার ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ শিরোনামে প্রচারিত প্রতিবেদন সারাবিশ্বে সাড়া ফেলেছিল, সেখানে হাসিনা, তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকীর দুর্নীতি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা রয়েছে।
মাহমুদুর বলেন, পৃথিবীর ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি, কোনো ফ্যাসিস্ট কিংবা অটোক্রেটিক রেজিমকে গণতান্ত্রিক উপায়ে অপসারিত করা যায়নি। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে আরব রেভুল্যুশনের সময় মিশর এবং তিউনিশিয়ায় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন দেখেছি। বাংলাদেশেও ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইতালি এবং জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি এবং হিটলারের পতন হয়েছিল যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর। জার্মানিতে সে সময় জনগণ, বিশেষ করে ইহুদি জনগোষ্ঠীর ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বে আওয়াজ উঠেছিল ‘নেভার অ্যাগেইন’। অর্থাৎ, আর যেন কখনো হিটলারের মতো নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট শাসকের আগমন না ঘটে।
জুলাই বিপ্লবের শহীদ ফাইয়াজের প্রসঙ্গ এনে এ সম্পাদক বলেন, কয়েকদিন আগে তার বাবা আমাকে ফোন করেছিলেন। একদিন পরে তার ছেলের ১৮ বছর হওয়ার কথা ছিলো। ফাইয়াজ ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই রিকশা করে বাড়িতে ফিরছিল। সেই রিকশার মধ্যেই ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। শহীদ ফাইয়াজের বাবা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, তার শহীদ ছেলের জন্মদিনে আমি যেন আমার দেশ পত্রিকায় একটা সংবাদ ছাপাই। আমি সেই বাবার অনুরোধ রক্ষা করেছি। শহীদ ফাইয়াজের বাবার মতো এমন অন্তত ১ হাজার ৪০০ শহীদের বাবা এবং মা সন্তানের শোক নিয়ে বেঁচে আছেন। এই শহীদ পরিবারগুলো ন্যায়বিচার দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। এর সঙ্গে আরও যে অন্তত ২০ হাজার আহত জুলাইযোদ্ধা চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, তারাও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কমান্ড রেসপনসিবিলিটিতে যারা ছিলেন, তাদের বিচার দেখতে চান।
মাহমুদুরের দাবি, যারা সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং যারা এ হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেননি, সবাই কমান্ড রেসপনসিবিলিটির আওতাভুক্ত।
জবানবন্দি দেওয়া শেষে মাহমুদুরকে রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন জেরা করেন।
জেরায় মাহমুদুর বলেন, এটা সত্য নয় যে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও গাছ কেটে ধ্বংস করেছে। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী মত দেন, ওই দিন সরকার জনগণের জানমাল রক্ষার্থে শান্তিপূর্ণ উপায়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিয়েছে এবং শাপলা চত্বরে কোনো গণহত্যা হয়নি। সাক্ষী জবাব দেন, তা সত্য নয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রভাবিত করার অভিযোগ সংশ্লিষ্ট স্কাইপে কেলেঙ্কারিতে হাসিনা জড়িত নন বলে আইনজীবী দাবি করলে মাহমুদুর বলেন, এটি সত্য নয়।
ট্রাইব্যুনাল পরে জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে শুনানি বুধবার (১৬ সেপ্টম্বর) পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করে।
এফএইচ/একিউএফ/এএসএম