বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে বিস্তৃত সুনামগঞ্জের হাওড় অঞ্চল শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, এখানকার খাদ্যসংস্কৃতিও স্বতন্ত্র। বিশেষ করে হাওড় অঞ্চলের দেশি হাঁসের মাংস স্থানীয় খাবারের তালিকায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে।
হাওড়ের খোলা জল, ভাসমান ফসলের জমি বা টংরের পাশে বেড়ে ওঠা দেশি হাঁসগুলো শারীরিকভাবে মজবুত এবং তাদের খাদ্যও প্রাকৃতিক। জলজ উদ্ভিদ, ছোট মাছ, পোকা-মাকড় ইত্যাদি খেয়ে তারা বেড়ে ওঠে। এই প্রাকৃতিক আহার হাঁসের মাংসে একটি ঘন, রসালো এবং খাস্তা স্বাদ তৈরি করে, যা সাধারণ বাজারের হাঁসের মাংসের তুলনায় অনেক বেশি সুস্বাদু।
স্থানীয়রা বলেন,‘হাওড়ের দেশি হাঁসের মাংস রান্না করলে তার ঘ্রাণই মানুষকে আকৃষ্ট করে।’ মাংসের স্বাদে রয়েছে মাটির গন্ধের কোমল ছোঁয়া, যা শহরের হাঁসের মাংস থেকে ভিন্ন। সেদিন হাওড়ের বুকে বেড়াতে যেয়ে খাবারের সময় কানে আসে স্থানীয়দের সতর্কতা। ‘খোলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা দেশি হাঁসই আসল স্বাদের’, জানালেন তারা।
হাওড়ের দেশি হাঁস রান্নার প্রক্রিয়াটি সরল হলেও সাবলীল। প্রথমে হাঁসগুলোকে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়, তারপর ছোট ছোট লোম আগুনে হালকা পুড়িয়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর হাঁসের ওপর হলুদ গুঁড়া, আদা-রসুন বাটা, লবণ, কিছু স্থানীয় মসলা এবং সামান্য তেল দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে ঘণ্টাখানিক ম্যারিনেটের জন্য রাখা হয়, যাতে মসলা মাংসের একেবারে ভেতর পর্যন্ত প্রবেশ করে।
তৃতীয় ধাপে, ধীরে ধীরে মাঝারি আঁচে ভাজা হয় হাঁস, যাতে বাহিরের অংশ হালকা খাস্তা হয়। ভাজা হলে হাঁসকে ঢেকে কম আঁচে দমে রান্না করা হয় প্রায় ৬০ মিনিট ধরে, মাঝে মাঝে মাংসের উপর তেল বা পানি ছিটিয়ে দিলে তা আরও রসালো হয়। রান্নার সময় বের হওয়া ঘ্রাণই প্রমাণ দেয় যে মাংস প্রকৃতির স্বাদ ধারণ করেছে।
মাংস রান্না হয়ে গেলে খাস্তা বাইরের অংশের সঙ্গে রসালো, কোমল মাংস মিলিয়ে পরিবেশন করা হয়। যা হাওড়ের দেশি হাঁসের অনন্য স্বাদের অভিজ্ঞতা দেয়। স্থানীয় চাষের চালের ভাতের সঙ্গে এই হাঁসের মাংসের স্বাদ ভোলা বড্ড কঠিন বটে!
শুধু রান্নার স্বাদ নয়, হাওড়ের দেশি হাঁস খাদ্যাভ্যাস, চলাফেরা এবং পরিবেশগত মানানসই হওয়ায় অন্যান্য হাঁসের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকরও। স্থানীয় মানুষরা প্রায়শই হাওড়ের দেশি হাঁসকে পুরোনো দিনের স্বাদ ও প্রকৃতির এক অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন।
আজ শহরে এই স্বাদ উপভোগ করতে গেলে বেশ খানিকটা খুঁজতে হয়। তবুও যারা একবার হাওড় অঞ্চলের দেশি হাঁসের মাংস খেয়েছেন, তারা জানেন প্রতিটি কামড়ে মাটির গন্ধ, প্রাকৃতিক পুষ্টি আর রসের এক অম্লান ছোঁয়া লেগে থাকে। শহরের হাঁটে পাওয়া বাণিজ্যিক হাঁসের মাংসের সঙ্গে কখনো মেলানো যায় না এই স্বাদ।
হাওড়ের দেশি হাঁস শুধু খাওয়ার বিষয় নয়; এটি একটি জীবন্ত অভিজ্ঞতা, প্রকৃতি ও স্থানীয় সংস্কৃতির এক রসায়ন। তাই যারা প্রকৃত স্বাদ ও ঐতিহ্য চান, তাদের জন্য হাওড়ের দেশি হাঁস চোখে দেখা অনন্য অভিজ্ঞতা হতে পারে। যা শুধু পেট নয়, মনকেও তৃপ্ত করে।
আরও পড়ুন
কেএসকে/এমএস