মৌলভীবাজারে আমন ধান আবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। তবে জেলার অন্যতম বড় হাওর কাউয়াদীঘিতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে পানিতে তলিয়ে গেছে আবাদি জমি আর বীজতলা। ফসল হারানোর শঙ্কায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড দিন-রাত পাম্প চালু রাখলেও কুশিয়ারা নদীতে নামছে না হাওরের পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন ধান রোপণ করায় তা পানিতে ডুবে যায়। হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন রোপণ করতে হলে হাওরের পানির লেভেল ৭.৫০ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন পাম্প হাউজ নির্মাণ করতে হবে।
বুধবার (২০ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিনে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বড়কাপন, জগতপুর, রায়পুর, আখাইলকুড়া, কাশিমপুরসহ কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ে দেখা যায় কোথাও ডুবে আছে বীজতলা, আবার কোথাও ডুবে গেছে রোপণ করা ফসলের জমি।
রোপা আমন আবাদের মৌসুম শেষ হওয়ার পথে, অথচ অনেক কৃষক এখনো জমিতে লাগাতে পারেননি আমনের চারা। বর্ষার শেষ দিকে মৌলভীবাজারের বৃহৎ হাওর কাউয়াদীঘিতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে হাওরের ফসলি জমি এখন পানির নিচে।
জগতপুর গ্রামের কৃষক মোত্তালিব মিয়া বলেন, ‘প্রত্যেক বছর জলাবদ্ধতায় আমরার সবকিছু কাড়িয়া লইয়া যার। অনেক অনেক টাকা পয়সার ক্ষতি হয়। এই পানি নিষ্কাশন না হওয়ার কারণে আমরার মতো অনেক গৃহস্থ অখল ক্ষতিগ্রস্ত হই গেছিনগি। পানি ঠিকমতো তারা হিছে না। পানি না হিছার কারণ কিতা ইটা আল্লায় কইতান পারইন।’
রায়পুর গ্রামের কৃষক শহীদ বলেন, ‘কাওয়াদীঘি হাওরে আমনের আবাদ করছিলাম। আমার আমন নষ্ট করি লাইছে জলাবদ্ধতা। ভাদ্র মাসের মধ্যে যদি পানি নিষ্কাশন না হয় আমরা যে হালিগুলা গজাইছি সব হালি নষ্ট অই যাইবো। যেকোনো মূল্যে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করইন।’
বড়কাপন গ্রামের কৃষক রেজাউল করিম খসরু বলেন, ‘এখানে যে ৮টি মেশিন আছে সেগুলো যদি ঠিকমতো চালানো হতো, ১৯ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমি পানির নিচে থাকতো না।’
কাউয়াদীঘি হাওরের কৃষকদের দাবি, হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য নির্মিত পাম্প হাউজ যথাসময়ে চালু রাখা হোক। পাশাপাশি হাওরের ছড়া ও নদীগুলো খনন করে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হোক।
হাওর রক্ষা আন্দোলনের সদর উপজেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, কাউয়াদীঘি হাওর কিনারে এখন আমন আবাদের ভরা মৌসুম। আমরা অনেকেই বীজতলা তৈরি করেছি, কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে ধান রোপণ সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার আবেদন করেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি৷ যার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
- আরও পড়ুন-
- দায়িত্ব গ্রহণ করলেন সিলেটের নতুন ডিসি সারওয়ার আলম
- সিএনজি পাম্পে গ্যাস নেওয়ার সময় বিস্ফোরণ, ১১ গাড়ি পুড়ে ছাই
- ময়লার শহর সাতক্ষীরা!
তিনি জানান, হাওরের সঙ্গে সংযুক্ত খাল নালা বা ছোট নদী যদি খনন করা হতো তাহলে পানির ধারণক্ষমতা বাড়তো।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এবার মৌলভীবাজার জেলায় ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করেছেন কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, কাউয়াদীঘি হাওরসহ জেলার হাওরগুলোতে খুব একটা জলাবদ্ধতা হবে না। কারণ কাউয়াদীঘি হাওরের কাশিপুর পয়েন্টে সেচ পাম্পগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু আছে। এগুলো যদি চালু থাকে আমার মনে হয় না আমন আবাদ বিঘ্ন ঘটবে। আমরা আশা করছি, কাউয়াদিঘী হাওরে ৯ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হবে।
তিনি জানান, এ বছর শতকরা ৯০ ভাগ জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। মৌসুমের যে বৃষ্টিপাত, সেটা আমনের জন্য খুব ভালো। আশা করছি, এ বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, কাউয়াদীঘি হাওরের ২৪ হাজার হেক্টর জমির পানি নিষ্কাশনের জন্য কাশিমপুরে রয়েছে ৮টি পাম্প মেশিন। বর্ষা মৌসুমে হাওরের পানি নিষ্কাশন করে এই পাম্প হাউজ। কিন্তু হাওরের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র রক্ষায় নিম্নাঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয় বলে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলীদ বলেন, পাম্প হাউজ প্রধানত করা হয়েছিল মে-জুন মাসে বোরো ফসলের সময় আগাম বন্যা বা বৃষ্টিপাতের ফলে ছড়ার পাহাড়ি ঢল নেমে আসে তাতে হাওরের পাকা ধান যাতে ডুবে না যায় সে জন্য। সাধারণত হাওর এলাকায় হাওরের কান্দিতে আমান ধান উৎপাদন হলেও হাওরের নিচু অঞ্চলে আমান ধান উৎপাদন সম্ভব হয় না। আগস্ট মাসের ডিজাইন লেভেল হতে হাওরে পানির সমতল কম থাকলেও বর্তমানে হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন ধান রোপণ করায় তা পানিতে ডুবে যায়।
তিনি বলেন, বর্ষাকালে ছড়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ পানি আসে সে পরিমাণ পানি বর্তমান পাম্প হাউজের মাধ্যমে নিষ্কাশন সম্ভব না। হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন রোপণ করতে হলে হাওরের পানির লেভেল ৭.৫০ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন পাম্প হাউজ নির্মাণ করতে হবে। তাছাড়া বর্ষাকালে হাওরের পানির লেভেল ৭.৫০ রাখলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে কি না সে বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা প্রয়োজন।
এফএ/এএসএম