হাত বাড়ালেই ‘চোরাই ফোন’, দেখেও দেখে না ‘প্রশাসন’

1 hour ago 7

চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দাদের কেনাকাটার জন্য অন্যতম নির্ভরতার স্থান রিয়াজউদ্দিন বাজার। ঐতিহ্যবাহী এ বাজারটি দেড়শ বছরের পুরোনো। এই বাজারে শাক-সবজি থেকে শুরু করে লাখ টাকা দামের মোবাইল ফোনও মেলে। খুচরার পাশাপাশি চলে পাইকারি বেচাকেনা। বিভিন্ন পণ্যের দামও তুলনামূলক কিছুটা কম। মোবাইল ফোন ব্যবসা ঘিরে এ বাজারে গড়ে উঠেছে বড়োসড়ো চোরাকারবারি চক্র। বাজারটির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতার নানান দিক নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে হাত বাড়ালে সহজেই মিলছে চোরাই ও অবৈধপথে আনা মোবাইল ফোন। বাজারের বিভিন্ন ফুটপাত, গলির দোকান আর ইলেকট্রনিক্স শোরুমের আড়ালে চলছে এসব মোবাইল ফোনের অবাধ বেচাকেনা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চোরা কারবারিদের ঠেকাতে জোর নজরদারি নেই, যেন দেখেও দেখে না ‘প্রশাসন’।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন চলে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। আবার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ছিনতাই হওয়া ফোন চলে আসছে বাংলাদেশে। দুই দেশের ছিনতাইকারী ও চোরাই ফোন কারবারিদের যোগসাজশে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের চোরাই ফোন বেচাকেনার ‘হাব’ হিসেবে পরিচিত রিয়াজউদ্দিন বাজার।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চোরাই ফোন বেচাকেনার জন্য প্রতিদিন রিয়াজউদ্দিন বাজারে অসংখ্য গ্রাহক ভিড় জমান। তুলনামূলক কম দামে স্মার্টফোন পাওয়া যায় বলে অনেকেই ঝুঁকছেন এ মার্কেটে। এসব ফোনের কাগজপত্র যেমন থাকে না, অনেক সময় ব্যবহার করতে গিয়েও পড়তে হয় বিপদে।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী খালেদ হোসাইন জানান, এখানে প্রায় হাজারের কাছাকাছি মোবাইল ফোনের দোকান আছে। অধিকাংশ দোকানে চোরাই স্মার্টফোন বিক্রি হচ্ছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব কারবারে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করছে। যারা বৈধ ব্যবসা করছেন তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বড় একটি চক্র দিনের পর দিন প্রকাশ্যে এ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সাম্প্রতিক সময়ে চোরাই মোবাইল ফোন বেচাকেনা ঠেকাতে পুলিশের পরিকল্পিত কোনো তৎপরতা নেই। রিয়াজউদ্দিন বাজারে কোনো অভিযানও চালাতে দেখা যায়নি পুলিশকে

গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে কোতোয়ালি থানার পুরোনো রেলস্টেশন ও চৈতন্যগলি এলাকায় অভিযান চালায় ডিবি বন্দর বিভাগের টিম-৫১। অভিযানে ১৪৮টি চোরাই মোবাইল ফোন; যার মধ্যে দুটি আইফোন এবং দুটি ডিএসএলআর ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়। অভিযানে চোরচক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

পুলিশ জানায়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর চান্দগাঁও থানার খাজারোড এলাকার বাসিন্দা আকবর হোসেন ডিবি কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। যেখানে তিনি জানান, গত ২৪ আগস্ট তার ভিভো ওয়াই০৩টি (Vivo Y03t) মডেলের মোবাইল ফোনটি চুরি যায়। তিনি সেটি উদ্ধারের জন্য গোয়েন্দা পুলিশের দ্বারস্থ হন।

হাত বাড়ালেই ‘চোরাই ফোন’, দেখেও দেখে না ‘প্রশাসন’

অভিযোগের ভিত্তিতে উপ-পুলিশ কমিশনার আবু বকর সিদ্দিকের নির্দেশনায় এসআই ইমাম হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান শুরু করে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পুরোনো রেলস্টেশনের একটি মোবাইল ফোনের দোকানে অভিযান চালিয়ে ৩৩ বছর বয়সী সোহেল মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৪৮টি মোবাইল ফোন।

পরে সোহেল মিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্টেশন রোডের চৈতন্যগলির একটি বহুতল ভবনের পঞ্চম তলায় অভিযান চালিয়ে ২৭ বছর বয়সী আব্দুল হাকিম রাকিব ও ২০ বছর বয়সী মো. ইয়াছিনকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের বাসা মেলে আরও ১০০টি মোবাইল ফোন এবং দুটি ডিএসএলআর ক্যামেরা।

গত ১৪ জুন চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানাধীন পলিটেকনিক্যাল আগার মোড় এলাকা থেকে রিয়াজউদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক চোরাই স্মার্টফোন চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩১টি চোরাই অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

এর আগে গত ২১ জানুয়ারি রিয়াজউদ্দিন বাজারের সালেহ মরিয়ম মার্কেটের সপ্তম তলার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চোরাই ৫২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

সিলেট ও আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে চোরাই পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব পণ্যের মধ্যে মোবাইল ফোনই বেশি। রিয়াজউদ্দিন বাজারে গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে। সেখানে অভিযানে গেলে খুব জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই কৌশলে এগোচ্ছে পুলিশ।- বলছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা

জানা গেছে, রিয়াজউদ্দিন বাজারে হাজারও পণ্যের ব্যবসা রয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোন বেচাকেনার দোকান আছে হাজারখানেক। এসব দোকানের মধ্যে দুই শতাধিক দোকানে চলে পুরোনো ফোন বেচাকেনা। এসব দোকানই মূলত চোরাই এবং দেশে-বিদেশে ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনের আড়ত।

কয়েক বছর আগে রিয়াজউদ্দিন বাজারের হাসিনা হক শপিং কমপ্লেক্সের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রথম ভারতীয় চোরাই মোবাইল ফোনের চালান জব্দ করে পুলিশ। ভারতে ছিনতাই হওয়া ১৬১টি মোবাইল ফোনের ওই চালান প্রবেশ করে সিলেট সীমান্ত দিয়ে। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চালানটি এসেছিল রিয়াজউদ্দিন বাজারে।

জব্দ হওয়া চালানের ওই মোবাইল ফোনগুলোর প্যাকেটের গায়ে লেখা ছিল ‘শুধুমাত্র ভারতীয় সিম ব্যবহারের জন্য’। তখন চালান জব্দ করলেও পাচারের সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হলেও তদন্তের ফলাফল শূন্য।

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় আইফোন ১৪ প্লাস ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন ছিনতাই হয় দীপান্বিতা সরকার নামে এক ভারতীয় নাগরিকের। তিনি কলকাতার মহেশতলা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তার অন্য একটি মোবাইলে ই-মেইলের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হন মোবাইলটির অবস্থান চট্টগ্রামে। এরপর তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে বার্তা পাঠান।

পরে সেই মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয় রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে। কলকাতায় ছিনতাই হওয়া সেই ফোন চোরাই চক্রের হাত ধরে চলে আসে রিয়াজুদ্দিন বাজারে। ঘটনাটি গত বছরের জুলাইয়ের।

হাত বাড়ালেই ‘চোরাই ফোন’, দেখেও দেখে না ‘প্রশাসন’

রিয়াজউদ্দিন বাজার সূত্রে জানা গেছে, বাজারটির মক্কা টাওয়ার, নালা হকার মার্কেট, রিজোয়ান কমপ্লেক্স, কালাম মার্কেট, ইসলাম মার্কেট, জলসা মার্কেট, করিম সুপার মার্কেট, সিডিএ মার্কেটসহ শতাধিক মার্কেটে প্রকাশ্যে চলছে চোরাই মোবাইল ফোন বেচাকেনা। ঢাকার ছিনতাইকারী চক্রগুলো সেসব মার্কেটে মোবাইল ফোন সাপ্লাই দিচ্ছে। আবার চট্টগ্রামে ছিনতাই হওয়া ফোন চলে যাচ্ছে ঢাকায়।

চোরাই মোবাইল ফোন কেনার প্রবণতা কমাতে গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারের কড়াকড়ি আইন প্রয়োগ করতে হবে।- বলছেন সচেতন ব্যবসায়ীরা

রিয়াজউদ্দিন বাজারে মোবাইল ফোন মেরামতকারী কয়েকশো ব্যক্তি ফোনের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি) কোড পরিবর্তনের কাজে যুক্ত। যদি কোনো মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করা যায় তবে সেই মোবাইল পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে। ভারতের চোরা কারবারিরাও রিয়াজউদ্দিন বাজারে মোবাইল সাপ্লাই দিচ্ছে।

বড় একটি চক্র দিনের পর দিন প্রকাশ্যে এ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সাম্প্রতিক সময়ে চোরাই মোবাইল ফোন বেচাকেনা ঠেকাতে পুলিশের পরিকল্পিত কোনো তৎপরতা নেই। রিয়াজউদ্দিন বাজারে কোনো অভিযানও চালাতে দেখা যায়নি পুলিশকে।

অভিযোগ রয়েছে, কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি চক্র রিয়াজউদ্দিন বাজার ঘিরে কালোবাজারিতে জড়িত। বড় অংকের টাকা চলে যায় পুলিশের বড় কর্তাদের পকেটে!

এ বিষয়ে জানতে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চোরাই বা চোরাচালান করে আনা মোবাইল ফোন এখানে এনে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করা হয়। আমরা গোয়েন্দাসহ মাঝেমধ্যেই সেখানে অভিযান পরিচালনা করি। সবশেষ আগস্টেও অভিযান পরিচালনা করে ১৫০টির মতো মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছি।’

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, সিলেট ও আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে চোরাই পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব পণ্যের মধ্যে মোবাইল ফোনই বেশি। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তৎপরতায় এগুলো বন্ধ করলে সুফল বেশি পাওয়া যেতো। রিয়াজউদ্দিন বাজারে গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে। সেখানে অভিযানে গেলে খুব জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই কৌশলে এগোচ্ছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক নাহিদুন্নবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়’ বলেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

তামাকুমন্ডি লেইন বণিক সমিতির সভাপতি সরওয়ার কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হলেও বাজারে চোরাই মোবাইল ফোন বেচাকেনা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। এগুলো বন্ধ করতে পারলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়তো।’

রিয়াজউদ্দিন বাজারের সচেতন ব্যবসায়ীরা বলছেন, চোরাই মোবাইল ফোন কেনার প্রবণতা কমাতে গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারের কড়াকড়ি আইন প্রয়োগ করতে হবে।

এমআরএএইচ/এমকেআর/এমএফএ/এমএস

Read Entire Article