হাতিরঝিলে নারী সাংবাদিকের মৃত্যু: আত্মহত্যা নাকি হত্যা?

1 month ago 25

রাজধানীর হাতিরঝিল লেক থেকে বেসরকারি টেলিভিশন গাজী টিভির সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর (৩২) মরদেহ উদ্ধার হয় মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) দিনগত রাতে। তিনি জিটিভির নিউজরুম এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এটি আত্মহত্যা না হত্যা, তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি এখনো।

পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্টের পর জানা যাবে মৃত্যুর আসল কারণ। সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর বড় বোন রাবিতা সারাহ হাতিরঝিল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করবেন।

এ ঘটনার আগে ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে সারাহ লিখেছিলেন, ‘জীবন্মৃত হয়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো।’

যা বলছেন সহকর্মীরা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে থাকা রাহানুমা সারাহর কয়েকজন সহকর্মী জানান, সহকর্মী হিসেবে তিনি অত্যন্ত একজন ভালো মনের মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গে কখনোই খারাপ ব্যবহার বা জোরে কথা বলেননি। তবে কেন, কী কারণে এ ঘটনাটি ঘটেছে এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি।

আমার বোন হলিক্রস কলেজ এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে। সে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। বাবা নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সভাপতি। আমার বোনও একজন সাংবাদিক। কী কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি।– বড় বোন রাবিতা সারাহ

আরেক সহকর্মী বলেন, ‘রাতে রাহানুমা হাতিরঝিলে গাছের নিচে বসে ছিলেন এবং একজন গার্ড তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত রাতে এখানে বসে আছেন কেন। জবাবে বলেন, আমার গাড়ি আসবে, এলে চলে যাবো। এর কিছুক্ষণ পরই কেউ একজন পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে বলে শুনতে পান তিনি।’

তবে সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর মৃত্যুর ঘটনায় বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভির পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

রাহানুমার পরিবার যা বলছে

রাহানুমা ঢাকার কল্যাণপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ইসলামবাগ কৃষ্ণপুরে। বাবার নাম বখতিয়ার শিকদার। তিনি নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সভাপতি।

বড় বোন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রাবিতা সারাহ বলেন, ‘আমরা ভোরে আমার বোন অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে আছে এমন সংবাদ পাই। পরে ঢাকা মেডিকেলে এসে দেখি আমার বোন আর বেঁচে নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমার বোন হলিক্রস কলেজ এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে। সে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। বাবা নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সভাপতি। আমার বোনও একজন সাংবাদিক। কী কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি।’

সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর শরীরে কোনো যৌন নিপীড়ন বা জখমের আলামত পাওয়া যায়নি। মৃত্যু সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। শরীরে বাহ্যিক কোনো আঘাত বা আঁচড়ের চিহ্ন নেই। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্তসহ অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাসুদুর রহমান

যা উঠে এলো সুরতহাল প্রতিবেদনে

তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর শরীরে কোনো যৌন নিপীড়ন বা জখমের আলামত পাওয়া যায়নি। মৃত্যু সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তার দেহ অচেতন অবস্থায় হাতিরঝিলের পানিতে ভাসমান ছিল। শরীরে বাহ্যিক কোনো আঘাত বা আঁচড়ের চিহ্ন নেই। কোনো যৌন নিপীড়নের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্তসহ অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সারাহর স্বামীর ভাষ্য

রাহানুমা সারাহর স্বামী সায়েদ শুভ্র জানান, তারা রাজধানীর কল্যাণপুরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। ২৭ আগস্ট রাহানুমা অফিসে যান। রাতে বাসায় না ফিরে এক ব্যক্তিকে দিয়ে বাসাভাড়ার টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে তাকে ফোন করে বাসায় না এসে অন্যকে দিয়ে কেন টাকা পাঠিয়েছে জানতে চান। তখন রাহানুমা বলেন, তিনি ব্যস্ত আছেন। এই বলে ফোন রেখে দেন। দিনগত রাত তিনটার দিকে তিনি খবর পান, রাহানুমা হাতিরঝিল লেকের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে তিনি রাহানুমার মরদেহ দেখতে পান।

৭ বছর আগে পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে

সায়েদ শুভ্র জানান, প্রেম করে সাত বছর আগে তারা পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিলেন। তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়নি। তবে বেশ কিছুদিন আগে থেকে রাহানুমা আলাদা হয়ে যেতে চাইছিল। তারা কাজী অফিসে গিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। তবে দেশের পরিস্থিতির কারণে তা আর করা হয়নি।

 আত্মহত্যা নাকি হত্যা?

বিষণ্নতা থেকে কি আত্মহত্যা?

সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর বন্ধুদের বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরে সারাহ মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত ছিলেন।

জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। বিষণ্নতার উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবার ও বন্ধুদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি বুঝতে পারে তাদের বন্ধু বিষণ্নতায় আক্রান্ত তাহলে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। মানসিক রোগ বা বিষণ্নতার চিকিৎসা না করলে মানুষটি আত্মঘাতী হতে চাইবে। এ রোগটিকে এড়িয়ে যাওয়া বা অবহেলার সুযোগ নেই।’

গানের অনুরাগী ছিলেন রাহানুমা

সাংবাদিক রাহানুমা সারাহ গানের অনুরাগী ছিলেন। ‘রাহানুমার রূপকথারা কভার বাই সারাহ’ নামে অডিও ওয়েবসাইটভিত্তিক সাউন্ড ক্লাউডে আইডি ছিল। সেখানে ঢুকে বেশকিছু গানের লিস্ট পাওয়া যায়।

রাহানুমার বন্ধু মেজবাহ উল আজিজ ফেসবুক স্টাট্যাসে জানান, আমাদের হসন্ত ছিল কিন্নরকণ্ঠী গায়িকা। তার কাছ থেকে আমি বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট বাজানোর টিপস নিতাম। বিভিন্ন গানের প্রোপার সুর তাল কোনটা হবে সেগুলো শিখতাম। অপরাজিতা তুমি মুভির রূপকথারা গানটা পুরোটা আমাকে তুলে দিয়েছিল হসন্ত। আজও ওই গান শুনলেই আমার ওর কথাই আগে মনে পড়ে।’ ভাল থেকো হসন্ত, একদিন আবার দেখা হবে। একসঙ্গে আবার রূপকথার গান গাইবো আমরা।

ফেসবুকে এলিজি

সারাহর বন্ধু সৈয়দ নাজমুস সাকিব ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সারাহ অনেকদিন থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, চিকিৎসাও নিয়েছিলেন। সবাই তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন।’

আরেক বন্ধু ফাহিম ফয়সাল লেখেন, ‘আমার বন্ধুটা আর নেই, কাল রাতে শেষ কথা আমার সাথেই হয়েছিল। যদি বুঝতে পারতাম এটাই আমাদের শেষ কথা, তাহলে কখনোই যেতে দিতাম না!’

সারাহর মৃত্যুতে শোকাস্তব্ধ তার বন্ধু চিকিৎসক মেজবাহ উল আজিজ লিখেছেন, ‘যে ডিপ্রেশনের জন্য আমরা লড়াই করতে চেয়েছিলাম, সেই ডিপ্রেশনের কাছেই আজ আমরা আবার হারলাম। সুইসাইড প্রজেক্টে কাজ করতে চাওয়া, ডিপ্রেশনের রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনতে চাওয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হাতিরঝিলের পানিতে নিথর ভেসে আছে আমাদের অপরাজিতা হসন্ত।’

অপমৃত্যু মামলা প্রক্রিয়াধীন

হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মৃত সাংবাদিকের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে জানা যাবে। ভুক্তভোগীর পরিবারে থেকে বড় বোন রাবিতা সারাহ একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করবেন। অপমৃত্যুর মামলাটি প্রক্রিয়াধীন।’

 আত্মহত্যা নাকি হত্যা?

হাতিঝিলেই মৃত্যু হয়েছে আরও সাংবাদিকের

২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি গভীর রাতে সাংবাদিক হাবীব রহমান (৪০) নিহত হন। মোটরসাইকেল আরোহী সাংবাদিক হাবীব রহমান দুর্ঘটনায় নাকি হত্যার শিকার হন সে রহস্য দুই বছরেও জানা যায়নি। হাবীব রহমান সময়ের আলোতে আওয়ামী লীগ বিটে কর্মরত ছিলেন।

একই বছর ৮ জুন হাতিরঝিল থেকে বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের প্রডিউসার আবদুল বারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ প্লাজার পাশে ফজলে রাব্বি পার্কের পেছনে লেকের ধার থেকে ক্ষতবিক্ষত মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। একমাস পর সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আব্দুল বারীর মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

তৎকালীন গোয়েন্দা-গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জানান, ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আব্দুল বারী খুনে কেউ জড়িত নন। তিনি ২০ টাকা দিয়ে ফল কাটার ছুরি কিনে নিজেই গলা কেটে আত্মহত্যা করেন। প্রচণ্ড মানসিক অবসাদ ও বিভিন্ন শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।

সবশেষ মঙ্গলবার দিনগত রাত পৌনে ২টার দিকে হাতিরঝিলের পানিতে ভাসমান অবস্থায় জিটিভির সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর (৩২) মরদেহ উদ্ধার হলো।

হাসপাতালে নিয়ে আসা পথচারী মো. সাগর বলেন, ‘রাত পৌনে ১টার দিকে হাতিরঝিল প্রথম ব্রিজের নিচে লেকের পানিতে ওই নারী ভাসমান অবস্থায় ছিলেন। পাশেই তার ব্যাগ ভাসছিল। পানি থেকে তুলে তাকে দ্রুত প্রথমে ফরাজী হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে সেখানে কোনো চিকিৎসা দেননি তারা। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’

টিটি/এএসএ/জিকেএস

Read Entire Article