হাসিনার পতনের খবর পেয়ে দুপুরেই সটকে পড়েন অনেকে

1 month ago 8

৫ আগস্ট ২০২৪। সকাল ১০টা। নগরীর চৌহাট্টা শহীদ মিনার এলাকা। মুখে মুখোশ পরে শুধু চোখ দুটো খোলা রেখে সশস্ত্র অবস্থানে ছিলো পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট। সঙ্গে ছিল পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শত শত সদস্য। সারিবদ্ধভাবে সাজানো ছিল সাজোয়া যান। এ যেন যুদ্ধের ময়দানে শত্রু পক্ষকে নিঃশ্বেস করার প্রস্তুতি।

ঘড়ির কাটায় সকাল সাড়ে ১০টা বাজতে ছাত্র-জনতার একটি মিছিল শহীদ মিনারের দিকে এগুতোই সশস্ত্র হামলা করে সোয়াট-পুলিশ সদস্যরা। দফায় দফায় চলে গুলি ও ইট পাটকেল নিক্ষেপ। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের খবর পেয়ে কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতার আরও কয়েকটি ছোট ছোট মিছিল শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে এলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। দফায় দফায় চলে সংঘর্ষ। পুলিশের মরণঘাতি অস্ত্রের মুখে ছাত্র-জনতার পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার একমাত্র অস্ত্র ছিল ‘ইট’। ইট দিয়ে ঢিল ছুঁড়ে পুলিশ সদস্যদের পিছু হটানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় আন্দোলনকারীরা। সোয়াট সদস্য নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। এসময় নিজেদের গুলিতে গুরুতর আহত হন এক সোয়াট সদস্য।

সকাল সাড়ে ১১টা। নিজেদের গুলিতে আহত সোয়াট সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ক্যাজুয়িলিটি বিভাগে তখন চিকিৎসা নিচ্ছিলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ। তিনিও আগেরদিন এক পুলিশ কনস্টেবলের ছররা গুলিতে আহত হয়েছিলেন। সোয়াট সদস্যরা এতোটাই রণ রূপ ধারণ করেছিলো, হাসপাতালে ঢুকতেই সাধারণ মানুষও ভয়ে সটকে পড়ে। এর আগে আজবাহার আলী শেখ হাসপাতালে প্রবেশের আগ মুহূর্তে ক্যাজুয়িলিটি বিভাগ থেকে আহত আন্দোলনকারীদেরও সরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসিনার পতনের খবর পেয়ে দুপুরেই সটকে পড়েন অনেকে

দুপুর ১২টা। আহত আজবাহার আলী ও সোয়াট সদস্যকে দেখতে আসেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া। ক্যাজুয়লিটি বিভাগের ভেতরে ঢুকে তিনি আজবাহার আলীকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। এরপরপরই আজবাহার আলী চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে ওঠে চলে যান হাসপাতালের পরিচালকের রুমে। এরপর আজবাহার আলীর সঙ্গে থাকা পুলিশ ফোর্সরাও হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়। এরপর অনেক খোঁজাখুজি করেও হাসপাতালে পুলিশ কর্মকর্তা আজবাহার আলী শেখকে পাওয়া যায়নি। তিনি ছিলেন সিলেটে ছাত্র-জনতার উপর হামলার অন্যতম হুকুমদাতা। এসময় সিলেট আওয়ামী লগের নেতারাও সটকে পড়েন বলে জানা যায়।

এর কিছু সময় পর টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে ওঠে দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান। কিছু একটা যে হয়েছে, সেটা ওসমানী হাসপাতালে পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আচরণেই আভাস মিলেছিল।

অন্যদিকে, দুপুর গড়ানোর আগেই কারফিউ ভেঙে সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নগরীর কোর্ট পয়েন্টে জড়ো হতে থাকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। বেলা ১২টার দিকে নগরীর বন্দরবাজার এলাকার মধুবন মার্কেটের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন হাজারও ছাত্র-জনতা। এসময়ও আন্দোলনকারীদের দমাতে ভারি ও মরণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করে পুলিশ-আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। দুপুর ২টা পর্যন্ত তাদের হামলায় আহত হয়েছেন অনেক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ।

হাসিনার পতনের খবর পেয়ে দুপুরেই সটকে পড়েন অনেকে

দুপুর ২টায় সেনাপ্রধানের ভাষণের সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এরই মধ্যে সিলেটের মানুষের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়েছেন। কিন্তু কেউই নিশ্চিত হতে পারছিলেন না।

বিকেল ৪টার দিকে এ খবর নিশ্চিত হওয়ার পর সিলেটের পাড়া মহল্লা থেকে হাজারও নুষের ঢল নামে রাজপথে। তারা স্লোগানে, মিছিলে বিজয় উল্লাস করতে থাকেন। মুহূর্তেই সিলেটের সব মিছিল মিলেছিল নগরীর চৌহাট্টাস্থ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। বিকেল গড়াতে গড়াতে নারীরাও নেমে আসেন রাস্তায়। এসময় সিলেটজুড়ে ছিল তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টি উপক্ষো করেও আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন সিলেটের লাখও মানুষ। এমন কোনো বাসা-বাড়ি নেই, যে বাড়ির মানুষজন আনন্দ উল্লাস করতে রাস্তায় নামেনি। রাত ৮টা পর্যন্ত চলে মানুষের উল্লাস।

এদিকে হাসিনা পলিয়ে যাওয়ার খবর নিশ্চিতের পর একদল লোক সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ ছাড়াও বিভিন্ন দোকানপাট, ফার্মেসি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এদিন বিকাল ৩টার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে এসব ঘটনা ঘটেছে। বিকাল সোয়া ৩টার দিকে সিলেটের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। এরপর সিলেট জেলা প্রশাসক কার্যালয়, জেলা পরিষদ কার্যালয়, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরের বাসা, সোবহানীঘাট ও লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ি এবং দক্ষিণ সুরমা থানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও বাসায় অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করা হয়।

এ দিন নগরীর অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নগরের নয়াসড়কে ফ্যাশন হাউস ‘মাহা’র শোরুমে হামলা ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। একইভাবে নগরের চৌহাট্টায় ইউনিক ফার্মা ও মেসার্স শাহপরান ফার্মেসিতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

এই পরিস্থিতিতে বিকেলের দিকে মাইক হাতে পিকআপ ভ্যানে করে শহর ঘুরে বেড়ান সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের মতো নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মাইকিং করে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও লুটপাটকারীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান।

হাসিনার পতনের খবর পেয়ে দুপুরেই সটকে পড়েন অনেকে

সিলেট জেলায় শহীদরা হলেন যারা

জুলাই আন্দোলনে সিলেট জেলায় শহিদ হয়েছেন ১৩ জন। এর মধ্যে সিলেট নগরীতে সাংবাদিক তুরাবসহ চারজন, গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ছয়জন, বিয়ানীবাজারে তিনজন।

সিলেটে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে জুলাই আন্দোলন

২০২৪ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে সিলেটে কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র গতি পায়। বিশেষ করে ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যা দেওয়ায় সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ১৪ জুলাই দিবাগত রাত ১টার দিকে শাবিপ্রবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করেন। রাত ১১টার দিকে হঠাৎ সৈয়দ মুজতবা আলী হল থেকে শুরু হয় ‘তুমি কে, আমি কে রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান। মাত্র কয়েকজন শিক্ষার্থীর শুরু করা প্রতিবাদ মিছিল ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধু হল, শাহপরাণ হলসহ অন্যান্য আবাসিক হলে।

সে সময় আন্দোলনকারী শাবির লোক প্রশাসনের শিক্ষার্থী আলতাফুর রহমান তাসনিম জানান, মুজতবা আলী হল থেকে ছাত্রদের মিছিল বের হলে শাহপরাণ হলে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তা প্রতিরোধে নামে। এই সময় স্লোগান দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর ওপর চড়াও হয় তারা। খবর পেয়ে ঘটনার ১৫ মিনিট পর প্রধান ফটক থেকে আন্দোলনকারী অন্য শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। তারা ছাত্রীদের হলের সামনে গিয়ে স্লোগান দিলে শতাধিক ছাত্রী মধ্যরাতে হল থেকে বের হয়ে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেয়। মিছিলে নারী শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি আন্দোলনকারীদের মনোবল আরও দৃঢ় করে তোলে।

একপর্যায়ে ক্যাম্পাসে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও মিছিলকারীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে গিয়ে সমবেত হয়। এই সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফের মিছিলে হামলা চালালে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে আন্দোলনকারী বেশ কয়েক জন আহত হন। পরদিন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

১৪ জুলাই শাবি ক্যাম্পাস ছাড়াও সিলেট শহরে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। দুপুরে সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির বরাবর স্মারকলিপি দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। স্মারকলিপিতে সরকারি চাকরিতে ৯৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত এবং সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ অনগ্রসর ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের দাবি জানানো হয়। সন্ধ্যার পর সিলেট নগরের চৌহাট্টার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে মশাল মিছিল বের করা হয়। যার ফলে ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক আন্দোলন সারা শহরে ছড়িয়ে যায়।

আহমেদ জামিল/এএইচ/এমএস

Read Entire Article