হুমায়ূন আহমেদ নামটি বাঙালির কাছে এক অমর নাম। তিনি ছিলেন এখন জাদুকর। তার হাতের জাদুতে তৈরি হয়েছে সাহিত্যের অমর কিছু চরিত্র, যার বাস্তবে কোনো স্বত্বা না থাকলেও আছে পাঠকের কল্পনায়। পাঠক এক সময় নিজেকে ভাবেন হিমু কখনো মিসির আলী। নারীরা রুপা হয়ে থাকতে চান সারাজীবন।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একজন বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ। নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাস, গান যাই লিখেছেন বা তৈরি করেছেন তা দর্শকের কিংবা পাঠকের কাছে কখনো পুরোনো হয়নি।
কয়েকবার দেখা তার নির্মিত কোনো সিনেমা আজও দেখতে বসলে মনে হয় যেন প্রথম দেখছি। শতবার পড়া গল্পের বইয়ের গন্ধ, গল্প যেন মনে হয় নতুন পড়ছি। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এমনই এক জাদুকর। তিনি যেন বশ করে রেখেছিলেন এক প্রজন্মকে তার সৃষ্টিতে।
হুমায়ূন আহমেদ তার লেখনীতে যে বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, তাতে এই চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে চিরজীবন্ত। আজও পাঠকরা নতুন প্রজন্মের কাছে এই চরিত্রগুলোকে নিজেদের মতো করে আবিষ্কার করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা লেখকের সৃষ্টির গণ্ডি পেরিয়ে পাঠকের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
তার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের কলমে জন্ম নেওয়া হিমু, রুপা, মিসির আলী কিংবা বাকের ভাই ঠিক তেমনই চারটি কালজয়ী চরিত্র। এই চারজন যেন আমাদের সমাজের চার ভিন্ন মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। একদিকে যুক্তি, অন্যদিকে আবেগ, মাঝখানে রহস্যময় জীবনের দর্শন, অন্যদিকে গ্যাংস্টার বা সমাজের চোখে অপরাধী। চলুন আজ প্রিয় লেখকের জন্মদিন নতুন করে এই চার চরিত্রের সম্পর্কে জানা যাক-
হিমু
বাস্তবে হিমু হওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। দিনের পর দিন কটকটে হলুদ রঙের এক পাঞ্জাবি পরে তপ্ত দুপুরে পিচঢালা রাস্তায় খালি পায়ে হেঁটে বেড়ানো। কিংবা সমাজের প্রচলিত নিয়ম-কানুন মানে না, নিয়মবিরোধী জীবনযাপন করে। কখনো রাতে হেঁটে বেড়ায়, আবার কখনো মানুষের জীবনে অদ্ভুতভাবে প্রবেশ করে গিয়ে তাদের জীবন বদলে দেয়।
হিমু, যার পুরো নাম হিমালয়, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রহস্যময় এবং প্রিয় চরিত্র। হিমুর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার অন্যরকম জীবনদর্শন। সে সমাজের প্রচলিত নিয়ম মানে না, কিন্তু তার প্রতিটি কাজের মধ্যে থাকে এক ধরনের মানবিকতা ও দার্শনিক ভাবনা।
তার কথায় কোনো ভান নেই; সরাসরি সত্য কথা বলে, যদিও তা অনেকের কাছে অস্বস্তিকর লাগে। অস্বাভাবিক আচরণ সত্ত্বেও মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। অনেকেই মনে করে তার মধ্যে বিশেষ কোনো মানসিক শক্তি আছে।
তার পোশাক হচ্ছে হলুদ পাঞ্জাবি, একসময় হুমায়ূন ভক্তদের মাঝেও আইকনিক প্রতীকে পরিণত হয়। হিমু মূলত একজন ভবঘুরে দার্শনিক, যিনি যুক্তির চেয়ে অনুভূতিকে বেশি গুরুত্ব দেন। তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য ‘মানুষকে সুখী করা’। এই অদ্ভুত, মায়াবী চরিত্রের জন্য হিমু আজও লাখো পাঠকের হৃদয়ে এক স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে।
রুপা
রুপা নামটা উচ্চারণ করলেই অনেকের চোখে ভেসে ওঠে এক অনিন্দ্যসুন্দর, বুদ্ধিমতী ও সংবেদনশীল তরুণীর ছবি। হুমায়ূন আহমেদের অনেক উপন্যাসে রুপা উপস্থিত থেকেও যেন এক রহস্যে মোড়া।সে কখনো হিমুর জীবনে আসে, কখনো দূরে সরে যায় তবুও তার অস্তিত্ব থাকে গভীরভাবে।
রুপা শুধু একটি প্রেমের চরিত্র নয়; সে বাংলা সাহিত্যে নারীর এক নতুন প্রতীক। যিনি সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুরুষের চোখে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সে ভালোবাসে, আবার নিজের অবস্থানও বোঝে। রুপার মধ্যে আছে স্বাধীনচেতা নারীর সত্তা, যে ভালোবাসাকে ছোট করে দেখে না, কিন্তু নিজের আত্মসম্মানকেও হারাতে চায় না।
হুমায়ূন আহমেদের লেখায় রুপা একদিকে নির্মল প্রেমের প্রতীক, অন্যদিকে নারীর আত্মমর্যাদার প্রতিরূপ। এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই রুপা হয়ে উঠেছে এক চিরচেনা অথচ অদেখা মুখ। নীল শাড়ি পড়া, কপালে ছোট্ট টিপ, চোখে কাজল দিয়ে আজও বাঙালি মেয়েরা রুপা সাজেন তাদের হিমুর জন্য। হাতে থাকে কিছু পদ্ম।
মিসির আলী
মিসির আলী লেখকের মনের আরেক কল্পনার চরিত্র। যে পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী, কিন্তু পাঠকের কাছে তিনি রহস্যভেদী এক কিংবদন্তি। তার জীবনে প্রেম নেই, কিন্তু রহস্যের ঘ্রাণ আছে। তিনি অলৌকিক বিষয়কে যুক্তি ও মনস্তত্ত্বের আলোয় ব্যাখ্যা করেন।
যখনই কোনো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, মানুষ যায় মিসির আলীর কাছে। আর তিনি ঠান্ডা মাথায় সব রহস্য উন্মোচন করেন, প্রায় গোয়েন্দার মতো দক্ষতায়। মিসির আলীর জীবনে এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা কাজ করে। তিনি যুক্তিতে বিশ্বাসী হলেও মাঝে মাঝে নিজের মনের গভীরে কিছু অলৌকিক শূন্যতা অনুভব করেন।
এ যেন হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির মধ্যেও এক দার্শনিক টানাপোড়েন। যেখানে বিজ্ঞান ও অজানার মাঝে চলমান এক মানসিক দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়। মিসির আলী চরিত্রটি দেখায়, মানুষ কেবল যুক্তির প্রাণী নয়, আবেগ ও রহস্যও তার অংশ।
বাকের ভাই
বাকের ভাই হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি এক অনন্য সৃষ্টি। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে এমন কিছু চরিত্র আছে, যাদের মৃত্যুতে দর্শক কেঁদেছিল বাস্তব মৃত্যুর মতো। ‘বাকের ভাই’ সেই বিরল চরিত্রগুলোর একটি। যিনি শুধু নাটকের অংশ নন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক সময়ের জনমানুষের আবেগ ও প্রতিবাদের প্রতীক।
বাকের ভাই চরিত্রটি প্রথম দেখা যায় হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও নির্দেশিত বিখ্যাত নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এ। ১৯৯০ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত এই নাটকই বাকের ভাইকে বাঙালির ঘরে ঘরে পরিচিত করে তোলে। চরিত্রটি অভিনয় করেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, যার প্রাণবন্ত অভিনয়ে বাকের ভাই হয়ে ওঠেন জীবন্ত এক মানুষ।
বাকের ভাই একজন গ্যাংস্টার বা সমাজের চোখে অপরাধী, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে আছে অসাধারণ এক মানবিক সত্তা। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, দুর্বল মানুষের পাশে থাকেন এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্যের পক্ষে লড়েন। তার ভাষায়- ‘আমি খারাপ না, আমি শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ বাকের ভাইয়ের এই সংলাপ আজও অনেকের মুখে মুখে ফেরে, কারণ এটি কেবল নাটকের কথা নয়, এটি ছিল এক প্রতিরোধের কণ্ঠস্বর, এক বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদী মনোভাবের প্রতিফলন।
বাকের ভাইয়ের জীবনে ভালোবাসার জায়গাটি দখল করে নেয় মারিয়া নামের এক তরুণী। এই ভালোবাসা নাটকের এক গভীর মানসিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। একদিকে সমাজের কঠিন বাস্তবতা, অন্যদিকে নির্মল ভালোবাসা।
বাকের ভাই প্রেমিক হিসেবেও সৎ, নিঃস্বার্থ ও রক্ষাকারী। সে কখনো মারিয়াকে তার কষ্টে ফেলতে চায় না, তাই ভালোবাসলেও তাকে নিরাপদ রাখার জন্য দূরে সরে যায়। এই আত্মত্যাগই তাকে শুধু প্রেমিক নয়, একজন মানবিক নায়কের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
বাকের ভাই মূলত সমাজের এক অবহেলিত শ্রেণির প্রতিনিধি। তিনি এমন এক তরুণ, যিনি রাষ্ট্র ও আইনের অবিচারের শিকার।
যদিও তাকে অপরাধী বলা হয়, তার অপরাধ আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নাটকে দেখা যায়, ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে বাকের ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়।
তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশে দর্শকরা এতটাই আবেগাপ্লুত হন যে, বাস্তব জীবনে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, সংবাদপত্রে প্রতিবাদ ছাপা হয়, রাষ্ট্রপতির কাছে দয়া প্রার্থনা করা হয়-‘বাকের ভাইকে বাঁচান!’ লেখক ফোনে হুমকিও পেয়েছিলেন বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দেওয়ার জন্য। এমন নজির বাংলা টেলিভিশনের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি।
নাটকের শেষ পর্বে বাকের ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেই দৃশ্য প্রচারের পর পুরো দেশজুড়ে যেন এক শোকের ছায়া নেমে আসে। দর্শকরা কেঁদেছিল যেন তাদের প্রিয় কেউ সত্যিই মারা গেছে।
হুমায়ূন আহমেদ নিজেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি ভাবিনি মানুষ এভাবে কল্পনার চরিত্রের মৃত্যুকে বাস্তব বলে গ্রহণ করবে।’ এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বাকের ভাই কেবল একটি নাটকের চরিত্র নয়; তিনি ছিলেন এক সময়ের সামাজিক প্রতিরোধের প্রতীক।
আরও পড়ুন
যে হাটে সংসারের গল্প বিক্রি হয় রঙিন পসরা সাজিয়ে
নলকূপের পানি শীতে গরম, গরমে ঠান্ডা থাকে কেন?
কেএসকে/এএসএম

2 hours ago
4








English (US) ·