নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। মানছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনাও। চলছে ইচ্ছে মতো। পরিচালকও ব্যস্ত। সহকারী পরিচালক বা অন্য কাউকে মানছেন না অধীনস্থরা।
হাসপাতালটির প্যাথলজি বিভাগের অনিয়ম অনুসন্ধানে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে। প্যাথলজি বিভাগে অনিয়ম চলছে একজন মেডিকেল অফিসারের ইচ্ছে মাফিক।
- আরও পড়ুন
- ৮৮ হাজার টাকা পর্যন্ত কমছে হার্টের রিংয়ের দাম
- শিশু হাসপাতালের সেবার মানে অভিযোগ না থাকলেও রয়েছে চোরের উপদ্রব
- ৬ অভিযোগ প্রমাণিত, ডা. ফাতেমা দোজাকে চূড়ান্ত বরখাস্তের সিদ্ধান্ত
- সরকারি টাকায় কেনা ওষুধে ‘বেসরকারি মোড়ক’
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া স্পেনের বিখ্যাত তিনটি মেশিন প্রতিস্থাপন করা হয়নি। বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকা একটি মেশিন চায়ের টেবিল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বাকি দুটো পড়ে আছে বাক্সবন্দি হয়েই। অথচ একের পর এক ছয়টি পুরাতন চায়নিজ মেশিন অনুমোদন ছাড়াই নেওয়া হয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অমান্য করে গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার পর নিয়েছে দুইটি মেশিন, সেগুলো স্থাপনও হয়ে গেছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যার পর বাক্স থেকে দুটি অননুমোদিত মেশিন খুলে রাখেন কোম্পানির লোকজন। ছবি: জাগো নিউজ
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এসব মেশিন দান করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। দানের হলেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই কেনো এসব নেওয়া হবে? কেননা আগেরগুলোই তো ব্যবহার তো হয় না। এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে
প্রতিষ্ঠানগুলো এসব মেশিন দিতে চিকিৎসক বা দায়িত্বপ্রাপ্তদের পেছনে লেগে থাকে। কোনোভাবে একটি মেশিন বিনামূল্যে ধরিয়ে তা প্রতিস্থাপন করতে পারলেই তাদের ব্যবসা শুরু হয়। মেশিন পরিচালনার রিএজেন্ট বিক্রি করে তারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাদের বাইরে অন্য কারো কাছ থেকে রিএজেন্ট কিনতে পারে না। এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের যেকোনো মূল্যে ‘ম্যানেজ’ করে মেশিন স্থাপন করানোই থাকে প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য। সেজন্য কাউকে টাকা দিয়ে, কাউকে বিদেশ ভ্রমণ করিয়ে ‘ম্যানেজ’ করা হয়। অনিয়ম করে মেশিনগুলো গ্রহণ করার কারিগর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান মেডিকেল অফিসার (কার্ডিওলজি) আব্দুল্লাহ আল মুয়ীদ খান সম্প্রতি থাইল্যান্ড সফর করে এসেছেন। তার সহকর্মীদের দাবি, অননুমোদিত মেশিন গ্রহণের বিনিময়ে তার এই বিদেশ সফর করিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
শিরোনামে গত ১৫ জুলাই প্রতিবেদন করে জাগো নিউজ। এতে উঠে আসে, এ বছরের শুরু থেকেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের স্টোরে পড়ে আছে স্পেনের অত্যাধুনিক হেমাটোলজি অ্যানালাইজার (৫ পার্টস), মাল্টি চ্যানেল কো-এগুলেশন অ্যানালাইজার এবং বিএ২১০ মডেলের মাইক্রোস্কোপ। নতুন মেশিনগুলো প্যাকেটজাত অবস্থায় পড়ে আছে। সেগুলোর মধ্যে প্রায় ১৬ লাখ টাকা মূল্যের মেশিন এখন চায়ের কেটলি রাখার টেবিল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। স্পেন থেকে প্রকৌশলী এসেও স্থাপনের অনুমতি না পেয়ে ফিরে গেছেন। অথচ এসব মেশিনের একটি মাল্টি চ্যানেল কো-এগুলেশন অ্যানালাইজারে হার্টের রোগীদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট পিটি আইএনআর ও এপিটিটি হয়। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটউট ও হাসপাতালে এসব টেস্ট হয় না। বাধ্য হয়ে আশপাশের বেসরকারি ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেন চিকিৎসকরা।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান আব্দুল্লাহ আল মুঈদ খান ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট গণেশ চন্দ্র তরফদার গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যার পর উপস্থিত থেকে দুটি অননুমোদিত মেশিন প্যাথলজি বিভাগে প্রবেশ করান। ছবি: জাগো নিউজ
এ নিউজে নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংবাদ প্রকাশের পরপরই হাসপাতালে ছুটে যান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. এ এইচ এম মইনুল আহসান। তিনি ঘটনার সত্যতা পেয়ে পরদিন (১৬ জুলাই) সে বিষয়ে তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি করে দেন। পাশাপাশি পৃথক চিঠিতে নির্দেশনা দেন- ‘তদন্ত চলাকালীন এবং তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনার পূর্ব পর্যন্ত বিধিবহির্ভূত কোনো মেশিন স্থাপন না করতে অনুরোধ করা হলো। ব্যত্যয় হলে পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধানগণ দায়ী থাকবেন।’
গিয়ে পাওয়া গেছে, এসব দানের মেশিনে মধু আছে।
- আরও পড়ুন
- ‘প্রক্রিয়াজাত খাবারে অতিরিক্ত লবণ, বাড়ছে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি’
- জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের পাশে কাতার-রেড ক্রিসেন্ট
- হার্ট অ্যাটাক হলে বুঝবেন যেসব লক্ষণে, তৎক্ষণাৎ যা করবেন
- স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনে ‘উপেক্ষিত’ হোমিও-ইউনানি-আয়ুর্বেদ
অথচ এই নির্দেশনা অমান্য করে গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যার পর গোপনে দুটি মেশিন গ্রহণ করেছে হৃদরোগ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগ। ৯ ও ১০ আগস্ট প্রতিস্থাপনও হয়েছে। এ সংক্রান্ত ছবি ও ভিডিও জাগো নিউজের হাতে এসেছে। মেশিন দুটি হলো চীনের তৈরি বায়ো-কেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার ও ইমিউনো-কেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুটি মেশিন গ্রহণ ও প্রতিস্থাপনে হাসপাতালের পরিচালক বা সহকারী পরিচালকের অনুমতি নেওয়া হয়নি। তারা জানেনও না। প্যাথলজি বিভাগের প্রধান মেডিকেল অফিসার (কার্ডিওলজি) আব্দুল্লাহ আল মুয়ীদ খান ও সম্প্রতি বদলি হওয়া ল্যাব ইনচার্জ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট গণেশ চন্দ্র তরফদার উপস্থিত থেকে এটা করেছেন।
এ বিষয়ে গণেশ চন্দ্র তরফদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জয়েন করেছি। ওই দিন (৭ আগস্ট) হৃদরোগে গেছিলাম। আমার কাছে চাবি ছিল তো, ওই চাবি দিতে গেছিলাম।’
মেশিন স্থাপনে বিষয়ে জানতে চাইলে গণেশ বলেন, ‘মেশিনের বিষয়ে স্যার (প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ও কার্ডিওলজির মেডিকেল অফিসার আব্দুল্লাহ আল মুঈদ খান) জানেন। স্যার উপস্থিত থেকেই মেশিন নিয়েছেন। আমিও তখন সামনে ছিলাম।’
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে রাখা অননুমোদিত মেশিন। ছবি: জাগো নিউজ
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত রোববার (১০ আগস্ট) প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে ডা. আব্দুল্লাহ আল মুঈদ খানকে পাওয়া যায়নি। পরে তার মুঠোফোনেও যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি। এমনকি প্রশ্ন লিখে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালেও জবাব দেননি।
হৃদরোগ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যস্ততার কারণে আমার এসব বিষয় দেখার সুযোগ হয় না। সহকারী পরিচালক মেজবাহর সঙ্গে কথা বলো।’
- আরও পড়ুন
- সিপিআর কী, তাৎক্ষণিক যেটার কারণে প্রাণে বাঁচলেন তামিম!
- সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের লক্ষণ কী?
- এখনো হাসপাতালে জুলাই আহতরা, মানসিক বিপর্যয়ে ৬৭ শতাংশ
- পরিবারের সদস্যদের মতো আহতদের পাশে ছিলেন চিকিৎসকরা
সহকারী পরিচালক ডা. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার পাশাপাশি স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী কোনো মেশিন গ্রহণ ও প্রতিস্থাপনে পরিচালকের অনুমতি নিতে হয়। যেহেতু নেয়নি, আমি পরিচালক মহোদয়কে অবহিত করে বিভাগীয় প্রধানকে তলব করব। জানতে চাইবো।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. এ এইচ এম মইনুল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদের এসব অনিয়মের বিষয় আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি রিপোর্টও দিয়েছে। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবো।’
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘বিষয়টি আমরা কঠোরভাবে মনিটরিং করছি। অনিয়মে জড়ালে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
এসইউজে/এমএমএআর/জিকেএস