চলতি সপ্তাহে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে স্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। এসব ঘটনায় চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি দিয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ। এ কর্মসূচি কেন্দ্র করে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ সূত্র জানায়, বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে গ্রামীণ ব্যাংকে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কে বা কারা এ অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছে সেটা জানা যায়নি। গাজীপুরে আলাদা তিন স্থানে তিনটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) রাত থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত জেলার শ্রীপুর, মহানগরীর ভোগড়া বাইপাস ও চক্রবর্তী এলাকায় এসব অগ্নিসংযোগ করা হয়। তিনটি ঘটনায় বাসগুলো পুড়ে গেলেও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে মঙ্গলবার ময়মনসিংহে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন দিলে চালক নিহত হন। গত দু-তিনদিনে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রাজনৈতিক কার্যালয় লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছে ককটেল।

এসব ঘটনায় দোষীদের দ্রুত শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। তারা সতর্ক করে বলেন, সহিংসতা অব্যাহত থাকলে দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাজনৈতিক সহিংসতা এখন নগরবাসীর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক এবং দ্রুত এ সংকটের সমাধান আসুক।- স্কুলশিক্ষার্থীর অভিভাবক ফারুক সোবহান
সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি, নাগরিকদের নিরাপদ চলাচল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন
সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি কম, সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
লকডাউন নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই: ডিবিপ্রধান
মিরপুরে শতাব্দী পরিবহনের বাসে আগুন
‘আমি একজন বাসচালক, রাজনীতি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না, আর কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নিইনি।’ বলেন রাজধানীর সোহেল নামে এক বাসচালক।
‘দৈনিক আয়ে আমার পরিবার চলে, কিন্তু সাম্প্রতিক অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনাগুলো আমাকে ভীষণ ভীত করে তুলেছে। আমি আহত হলে বা মারা গেলে আমার সন্তান ও পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সোহেল বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার দাবি—সব রাজনৈতিক দল যেন সহিংসতা পরিহার করে। সরকারকেও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন এ ধরনের সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয় এবং সাধারণ মানুষের জীবন নিরাপদ থাকে।’

বুধবার (১২ নভেম্বর) ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটও তুলনামূলক ফাঁকা দেখা গেছে। রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়িও কম।
চলমান সহিংস পরিস্থিতিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেও গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় তারা সন্তানদের আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠানোর কথা ভাবছেন। তারা সরকার ও সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন—সহিংসতা বন্ধ করে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
অবশ্যই আমরা শঙ্কিত। তবে আমরা মনে করি না এটি বড় আকারের কোনো সমস্যা হবে। আমরা আশাবাদী যে সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। আমরা কিছুটা কাজও করছি।- বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম
রাজধানীর সেন্ট জোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ককটেল, মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে প্রিপারেটরি স্কুলে দুটি পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আতঙ্কে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকরা। অনেক স্কুল এরই মধ্যে ১৩ নভেম্বর ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্থগিত করেছে ক্লাস-পরীক্ষা। অনলাইনে কার্যক্রম চালাচ্ছে কেউ কেউ।
মিরপুরের বাসিন্দা ও এক স্কুলশিক্ষার্থীর অভিভাবক ফারুক সোবহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি অনুকূল নয়, তাই আমি আগামীকাল আমার ছেলেকে স্কুলে পাঠাবো না। রাজনৈতিক সহিংসতা এখন নগরবাসীর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক এবং দ্রুত এ সংকটের সমাধান আসুক।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যদি এ অস্থিরতা অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে এটি দেশের জন্য একটি খারাপ সংকেত হিসেবে দেখা দিতে পারে।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘অবশ্যই আমরা শঙ্কিত। তবে আমরা মনে করি না এটি বড় আকারের কোনো সমস্যা হবে। আমরা আশাবাদী যে সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। আমরা কিছুটা কাজও করছি। আমি আশা করি সব রাজনৈতিক দল বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রাখবে, যেন কেউ এ ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। আমরা সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা কামনা করি। ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য অন্তত শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন ‘ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা দেশের মানুষকে বিপদে ফেলতে এমন কোনো কর্মকাণ্ড কখনোই সমর্থন করি না। অতীতে আমরা সমর্থন করিনি, এখনো করি না এবং ভবিষ্যতেও করবো না। এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’
সাম্প্রতিক অগ্নিসংযোগ ও গণপরিবহনে আগুন লাগার ঘটনায় অফিসগামী ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে হঠাৎ আক্রমণের ভয় বিরাজ করছে।
কিছুদিন ধরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের।- ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী
রাজীব খন্দকার নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘আমাকে অফিসে যেতে হবে, কিন্তু ভয় হচ্ছে যে দুষ্কৃতকারীরা তাদের সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আহত করতে পারে। যাত্রাপথটি এখন নিরাপদ মনে হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি নিয়মিত তল্লাশি চালাতো, তবে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যেত।’

সতর্ক অবস্থানে পুলিশ
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘গত কয়েকদিনে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হেলমেট ও মাস্ক পরে ভোরবেলা অথবা দিনের ব্যস্ততম সময়ে টার্গেট করা স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি রাজনৈতিক দল। অনেক সময় ককটেল বিস্ফোরণে অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। দু-একটি মোটরসাইকেল থেকে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এসব ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘কিছুদিন ধরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের। গত কয়েকদিনে ঢাকা শহরে ককটেলসদৃশ বস্তু নিক্ষেপ এবং বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোসহ আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করার অপচেষ্টা রয়েছে।’
ঢাকাবাসী আমাদের সঙ্গে আছে- তাই কোনো অঘটন ঘটলে তা মোকাবিলার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে বলেও জানান তিনি।
আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/এমএস

2 hours ago
5








English (US) ·