সীমানা পুনর্নির্ধারণের ওপর তৃতীয় দিনের শুনানিতে অংশ নিয়ে ২০০১ সালের আসন ফেরত চেয়েছেন কয়েকটি জেলার আবেদনকারীরা। মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এবং ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহারসহ কয়েকটি এলাকার আবেদনকারীরা ২০০৮ সালে কেটে নেওয়া আসন ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের পুনঃনির্ধারিত খসড়া সীমানায় তাদের আসন ফেরত না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
ঢাকার সাভার ও আশুলিয়া উপজেলার বাসিন্দারা পৃথক আসন চেয়েছেন। এদিকে একটি আসন বাড়ানোয় নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ধন্যবাদ জানিয়েছেন গাজীপুর বিএনপির কয়েকজন নেতা। এছাড়া ঢাকা-২, ৩ ও ১৯, নারায়ণগঞ্জ-৩ ও ৫ আসনসহ কয়েকটি আসনের সীমানা পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলেছেন সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীরা।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার ২৮টি আসনের ওপর ৩০৯ আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ২৫৯টি খসড়া সীমানার বিপক্ষে এবং পক্ষে ৫০টি আবেদন ছিল। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের সঞ্চালনায় শুনানিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন ও চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। বুধবার পঞ্চগড়, রংপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার ১৮টি আসনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে দিয়ে চারদিনের শুনানি শেষ হবে। এরপর নির্বাচন কমিশন যে কোনো সময়ে চূড়ান্ত সীমানার তালিকা প্রকাশ করবে।
২০০১ সালের সীমানা ফেরানোর দাবি
২০০১ সালের আসনে ফেরত যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জবাসী, মুন্সিগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জবাসী।
শুনানিতে দোহার ও নবাবগঞ্জ সংসদীয় আসন (ঢাকা-১ ও ২) পুনরুদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক মো. হুমায়ূন কবীর নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে বলেন, বিগত সরকারের স্বৈরাচারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অন্যতম হাতিয়ার ছিল ঢাকার আসন ১৩টি থেকে বাড়িয়ে ২০টি করা। ওই সরকারের সব কর্মকাণ্ড ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। বিগত সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন-সংগ্রামে স্বৈরাচার সরকার শুধু ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরো দেশ পরিচালনা করতো। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা আবারও কোন স্বৈরাচারী সরকার চাই কি না।
তিনি বলেন, আগামী দিনে স্বৈরাচার নাকি জনবান্ধব সরকার আসবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে ইসির ওপর। আপনারা যদি আগামীতে স্বৈরাচার সরকার না চান, তাহলে ২০০৮ সালে কমবেশি ১৫০ আসন কাটা ছেঁড়া করা নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। ২০০৮ সালের আগের সব নির্বাচনে দোহার উপজেলা নিয়ে ঢাকা-১ ও নবাবগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ঢাকা-২ আসন গঠিত ছিল। এই দুই আসনের সিংহভাগ মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হওয়ার অপরাধে ২০০৮ সালে দুইটি আসনকে একটিতে রূপান্তর করা হয়েছে।
তিনি দোহার উপজেলাকে ঢাকা-১ ও নবাবগঞ্জ উপজেলাকে ঢাকা-২ আসন নির্ধারণ করার দাবি জানান।
জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) যুগ্ম-আহ্বায়ক ও দোহারের বাসিন্দা কে এম খালেদুজ্জামান জুয়েল শুনানিতে বলেন, ২০০৮ সালে ফ্যাসিজম কায়দায় নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলা মিলিয়ে একটি আসন করা হয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এখনও সেই চিত্র দেখছি। গাজীপুরে একটি আসন বাড়ানো হলো।
ইসির প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ঢাকা জেলায় কি জনসংখ্যা বাড়েনি?
তিনি ২০০১ সালের সীমানা অনুযায়ী, নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলাকে পৃথক আসন করার দাবি জানান। জাতীয় নাগরিক পার্টির-এনসিপি ঢাকা জেলার প্রধান সমন্বয়ক মো. রাসেল, জাসাস এর সাবেক সহ-সভাপতি সালাহউদ্দিন মোল্লাসহ আরও কয়েকজন তাদের বক্তব্যে একই দাবি জানান।
শুনানিতে মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের আসন পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন দুইটি জেলার প্রতিনিধিরা। মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতা বলেন, আমি এখানে এসেছি মানিকগঞ্জের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। ২০০১ সালের মতো মানিকগঞ্জে চারটি আসনের দাবি মানিকগঞ্জের সব স্তরের মানুষেরই দাবি।
এ সময় মানিকগঞ্জের প্রতিনিধি ব্যারিস্টার খাইরুল আলম চৌধুরী বলেন, ২০০১ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জ জেলায় ৪টি সংসদীয় আসন ছিল। ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জে একটি আসন কমিয়ে তিনটি করা হয়। এতে করে সংসদে মানিকগঞ্জের জনগণের প্রতিনিধিত্ব কমেছে। চারটি আসন থাকায় মানিকগঞ্জে যে বরাদ্দ ছিল তা কমে গেছে। আমরা ২০০১ সালের আসনে ফেরত যাওয়ার পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি।
আসন বাড়ানোয় ইসিকে ধন্যবাদ গাজীপুর বিএনপির
গাজীপুরে একটি আসন বাড়ানোয় নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন গাজীপুর বিএনপির নেতারা। শুনানিতে বিএনপি নেতা এ কে এম ফজলুল হক মিলন বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল গাজীপুরে আসন বাড়ানোর। সিইসি ও অন্য যে নির্বাচন কমিশনার বর্তমানে রয়েছেন, তারা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় এক নম্বরে রয়েছেন। আপনারা গাজীপুরবাসীর প্রতি যে বদান্যতা দেখিয়েছেন তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। সময়যোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে কোনো ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের পাশে থেকে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। যে কোনো আন্দোলন, সংগ্রাম বলেন- ন্যায়সঙ্গত বিষয়ে সাড়া দেবো। অধিকার আদায়ে ইসিকে সহায়তা করবো।
শুনানি থেকে বেরিয়ে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম মঞ্জুরুল করিম রনি বলেন, আমাদের কয়েকজন আজকের শুনানিতে বিভিন্ন আসনে থানা, ওয়ার্ড সংযোজনের দাবি জানিয়েছেন। বাকি সবাই ইসির পক্ষে ছিলাম। আসন বাড়ানোয় আমরা কমিশনকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি।
অন্য আসনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি
শুনানিতে অন্য আসনগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন আবেদনকারীরা। ইসিতে শুনানি থেকে বেরিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি মাকসুদুল খন্দকার খোরশেদ সাংবাদিকদের বলেন, এখানে আমি প্রতিবাদ জানাতে এসেছিলাম। আমাদের নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে পাঁচটি ইউনিয়নকে কেটে সোনারগাঁও (নারায়ণগঞ্জ-৩) আসনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভৌগোলিকভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছে। সেই বঞ্চনার কথা উপস্থিত কমিশনকে আমি জানিয়েছি।
তিনি বলেন, এখন যদি একটা বিরাট অংশ বিভক্ত হয়ে সোনারগাঁওয়ের সঙ্গে চলে যায়। আমরা এতদিনে যেই নেতাকর্মী তৈরি করেছি তাদের মধ্যে অনেকে প্রার্থী আছে। আমরা সবাই বঞ্চিত হবো।
খোরশেদ দাবি করেন, সবচেয়ে বড় কথা নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নকে কেটে নেওয়া হচ্ছে। ফলে যে প্রশাসনিক অখণ্ডতার কথা বলা হয়েছে সেই অখণ্ডতার বিষয়টা পুরোপুরি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সীমানার কারণে আগামী নির্বাচনও আটকে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ঢাকা-২, ৩ ও ১৯ আসন নিয়ে শুনানিতে খসড়া সীমানার পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন বেশ কয়েকজন। মেজর (অব.) মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকা-২, ৩ ও ১৯ আসনের সীমানা নির্ধারণে ইসি নিজের নীতিমালাই লঙ্ঘন করেছে। সাভার উপজেলায় ৯ লাখ ৬৫ হাজার, আশুলিয়া উপজেলায় ১৩ লাখ এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলায় ১০ লাখ জনসংখ্যা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন এই তিন উপজেলার অখণ্ডতা লঙ্ঘন করেছে।
তিনি কেরানীগঞ্জ, সাভার ও আশুলিয়া উপজেলাকে পৃথক তিনটি আসন করার দাবি জানান।
রাওয়া ক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল হক বলেন, কেরানীগঞ্জে ব্যক্তিস্বার্থে আসনবিন্যাস করা হয়েছিল। সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের স্বার্থে কেরানীগঞ্জকে দুটি আসন করা হয়েছে। এতে প্রশাসনিক অখণ্ডতা রক্ষা করা হয়নি।
এমওএস/এএমএ/এমএস