২০২৬ সালের মধ্যেই রপ্তানি করতে চায় ‘প্রোপার্টি লিফটস’

3 weeks ago 9

নরসিংদীর ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অবস্থিত এক লাখ স্কয়ার ফুট আয়তনের কারখানায় ইউরোপীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে লিফট তৈরি করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান প্রোপার্টি লিফটস। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৬ সালের মধ্যেই লিফট রপ্তানি করতে চায় এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য গ্লোবাল ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চায়। এ লক্ষ্যে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

১৯৮৮ সালে লিফট আমদানির মাধ্যমে ব্যবসায় শুরু হলেও ২০১৮ সাল থেকে নিজস্ব কারখানা চালু করে প্রোপার্টি লিফটস। এখন অধিকাংশ যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে কারখানাটি। যেখানে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

কারখানা ঘুরে যা দেখা গেলো
দেশের বাজারে প্যাসেঞ্জার, হাসপাতাল, ক্যাপসুল, কার্গো— এ চার ধরনের লিফট রয়েছে। এসব লিফট ব্যবহৃত হচ্ছে বাসাবাড়ি, বহুতল বিপণি-বিতান, হাসপাতাল ও শিল্পকারখানায়। তবে বর্তমানে প্যাসেঞ্জার লিফটের পাশাপাশি কার্গো লিফটের চাহিদাও বাড়ছে।

২০২৬ সালের মধ্যেই রপ্তানি করতে চায় ‘প্রোপার্টি লিফটস’

এসব লিফট তৈরির জন্য ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে সুবিশাল একটি কারখানা ও সঙ্গে নিজেদের তৈরি লিফট পরীক্ষার জন্য উন্নতমানের ল্যাবরেটরি ও ৫০ মিটার উচ্চতার (১৭ তলা) টেস্ট টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে।

কারখানায় লিফট তৈরির সবধরনের লোহা ও ইস্পাত কাটা হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে (সিএসসি) মেটাল কাটিং মেশিনে। যেখানে ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত পুরো লোহাও কাটা যায় অনায়াসে। এমনকি লেদের সম্পূর্ণ কাজও হচ্ছে ফাইবার লেজার কাটিং মেশিনে। যেখানে লিফটের দরজা বা প্যানেলের জন্য মেটাল কাটা যাচ্ছে মাত্র একজন অপারেটরের মাধ্যমে।

রয়েছে স্বয়ংক্রিয় বেন্ডিং মেশিন। অর্থাৎ কোন মেটাল কতটুকু ভাজ হবে সেটাও প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দেওয়া। মোট কথা একটি মেটাল নিজস্ব আকার ধারণ করা পর্যন্ত মানুষের হাতের স্পর্শের প্রয়োজন হচ্ছে না। মাত্র কয়েকজন এসব মেশিন পরিচালনা করেই কয়েকশ মানুষের কাজ করছেন নিখুঁতভাবে।

এদিকে কারখানার মধ্যে কন্ট্রোল প্যানেল অ্যাসেম্বলিং ইউনিটে তৈরি হচ্ছে লিফটের কন্ট্রোল প্যানেল। সেখানে ব্যবহৃত কম্পোনেন্টের ৭০ শতাংশ কারখানায় তৈরি। বাকি কিছু কম্পোনেন্ট এখনো আমদানি করতে হচ্ছে। সেসব তৈরিরও পরিকল্পনা রয়েছে প্রোপার্টি লিফটসের।

২০২৬ সালের মধ্যেই রপ্তানি করতে চায় ‘প্রোপার্টি লিফটস’

এছাড়া লিফটের জন্য মূল মোটর আমদানি করতে হচ্ছে এখনো। এসব মিলিয়ে ফাইনাল অ্যাসেম্বলিং ইউনিটে সংযোজন হচ্ছে পুরো লিফট। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রোপার্টি লিফটসের কারখানায় ২১০ জন কর্মী কাজ করছেন।

মাসে ২৭০টি লিফট তৈরি করা সম্ভব, গড়ে ১২০টি
আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আর এন পাল বলেন, এ দেশে ক্রমবর্ধমান লিফটের চাহিদা বাড়ছে। আমদানি করা লিফটের দাম যেমন বেশি, তেমনি পুরোনো ভবনে কাস্টমাইজড লিফট বসানোর সুযোগও সীমিত। এ বাস্তবতায় দেশে লিফট তৈরির কারখানা স্থাপন করেছি আমরা, যা ক্রমাগত ভালো অবস্থানে যাবে, আমাদের কারখানার পরিধিও বাড়বে। এছাড়া ২০২৬ সালের মধ্যে লিফট রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে চাই বিশ্বের অন্যান্য গ্লোবাল ব্র্যান্ডের সঙ্গে।

সর্বোচ্চ গুরুত্ব নিরাপত্তায়
লিফটের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোপার্টি লিফটস নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল দুই ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু নিরাপত্তা নয়, বিদ্যুৎ সাশ্রয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রোপার্টি লিফটে ক্রেতার সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মোটর ব্যবহার করা হয়, যা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। বিদ্যুৎ অপচয়ের কোনো সুযোগ নেই।

২০২৬ সালের মধ্যেই রপ্তানি করতে চায় ‘প্রোপার্টি লিফটস’

প্রোপার্টি লিফটসের চিপ অপারেটিং অফিসার মইনুল ইসলাম বলেন, ক্রোতাদের বিশ্বমানের লিফট সরবরাহে উন্নত প্রযুক্তির মোটর ও কন্ট্রোল প্যানেলে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মান পরীক্ষার জন্য উন্নতমানের ল্যাব, আধুনিক টেস্টিং ফ্যাসিলিটিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে, যা একটি সুরক্ষিত পণ্য প্রস্তুতের জন্য করা।

আমরা মান ও নিরাপত্তার দিক থেকেও গ্লোবাল ব্র্যান্ডের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছি। সুরক্ষার জন্য সর্বাধুনিক সব ব্যবস্থা আমাদের লিফটে থাকবে।

আমাদের প্রতিটি লিফটে অটো রেসকিউ ডিভাইস থাকছে। আমরা লিফটের ওভার স্পিড গভর্নর সেস্ট করছি। কোন লিফট অতিরিক্ত গতিতে পৌঁছালে, সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও অনেক প্রস্তুতকারক সাশ্রয়ী লিফট তৈরির জন্য এসব ব্যবহার করে না। কিন্তু আমরা আমাদের প্রতিটি লিফটে সব সুরক্ষা শতভাত নিশ্চিত করছি। প্রতিটি লিফটই এসব বিষয় বিবেচনায় ডিজাইন করা হয়।

দেশে তৈরি এসব লিফট সাশ্রয়ী
প্রোপার্টি লিফটসের হেড অব রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সবুল আলম বলেন, যেহেতু বিদেশ থেকে আমদানি করা লিফটের ক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ শুল্ক-কর রয়েছে, সে কারণে দেশে তৈরি করা লিফট দামে সাশ্রয়ী।

তিনি বলেন, ধারণক্ষমতা ও ফিচারের ওপর ভিত্তি করে এসব লিফটের দাম ১৫ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত। সমমানের আমদানি করা লিফটের তুলনায় দেশে উৎপাদিত লিফটের দাম ৫-৭ লাখ টাকা কম।

দেশে লিফটের বাজার কেমন?
প্রোপার্টি লিফটস ছাড়া দেশে বর্তমানে লিফট তৈরি করছে ওয়ালটন। বাংলাদেশে ব্যবহার হওয়া লিফটের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ এখনো আমদানি করা। দেশীয় কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে উন্নতমানের লিফট সরবরাহ করায় আমদানির প্রবণতা ক্রমেই করছে।

jagonews24

খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে লিফটের বাজার এক হাজার ৩০০ কোটি টাকার। বছরে গড়ে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার ইউনিট বিক্রি হয়। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ১০-১৫ শতাংশ। এ হার ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বর্তমানে লিফটের চাহিদা মূলত ঢাকাসহ বড় বড় নগরকেন্দ্রিক। ঢাকা ও এর আশপাশে লিফটের চাহিদা ৪৫ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২০ শতাংশ। দাম কমলে এবং দেশে ব্যাপকভাবে উৎপাদন হলে চাহিদা তৈরি হবে বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

প্রোপার্টি লিফটস ৩৬ বছরের অভিজ্ঞতা
দেশে লিফট উৎপাদন ছাড়াও বর্তমানে প্রোপার্টি লিফটস বিশ্বসেরা কোনে, ম্যাকপুয়ার্সা ও এসআরএইচ লিফটের বাংলাদেশে একমাত্র পরিবেশক। দীর্ঘ ৩৬ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার ফলে এ খাতের খুঁটিনাটি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণ ধারণা রয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, কিছু ইলেকট্রোমেকানিক্যাল উপাদান বাদে প্রায় সবকিছুই দেশে তৈরি সম্ভব, আর সেটি করলে উৎপাদন খরচও কমে আসবে, যা লিফটের চাহিদা আরও ব্যাপকভাবে বাড়তে সহায়তা করবে।

প্রোপার্টি লিফটস বর্তমানে ৪০ শতাংশের বেশি মূল্য সংযোজন করছে। মৌলিক কাঁচামাল আমদানি হলেও ফ্যাব্রিকেশন ও অন্যান্য কাজের ৮০ শতাংশ দেশেই সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে ৮০ শতাংশ কম্পোনেন্ট স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করেছে প্রতিষ্ঠানটি। একটি আধুনিক টেস্টিং টাওয়ার রয়েছে, যেখানে প্রতি সেকেন্ডে ৩ মিটার গতিতে লিফট পরীক্ষা করা যায়। এটি মান নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখছে।

নিয়োগ হবে আরও ৫ হাজার কর্মী
নরসিংদীর কারখানায় বর্তমানে ২১০ জন কর্মী কাজ করছেন। ইনস্টলেশন ও সার্ভিসিংয়ের জন্য হাজারেরও বেশি মানুষ যুক্ত। সারাদেশে নিরাপদ লিফট স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে আরও ৫ হাজার জন নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। ভবিষ্যতে মোটর ও কন্ট্রোল প্যানেল উৎপাদনের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রয়োজন নীতিসহায়তা
আরএফএল গ্রুপের এমডি আর এন পাল বলেন, দেশে লিফটের মান তদারকি করার কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। যে কারণে যত্রতত্র কিছু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান যন্ত্রাংশ আমদানি করে লিফট বানিয়ে দিচ্ছে, যা ঝুঁকিপূর্ণ ও দেশি কোম্পানিগুলোর সুনাম ক্ষুণ্ন করছে।

এছাড়া সুনির্দিষ্ট নীতিসহায়তা ছাড়া প্রতিযোগিতা করা কঠিন হবে। সে কারণে সরকারের উচিত বিভিন্ন প্রকল্পে দেশে তৈরি লিফট ব্যবহারে উৎসাহিত করা। মানুষের মধ্যে এখনো ভুল ধারণা আছে যে লিফট একটি জটিল পণ্য, যা বাংলাদেশি কোম্পানির পক্ষে উৎপাদন সম্ভব নয়। কিন্তু আরএফএল বহু জটিল পণ্য তৈরি করে আসছে, লিফটের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। সঠিক নীতিসহায়তা ও গণসচেতনতা বাড়লে বাংলাদেশ শুধু লিফটে স্বনির্ভরই হবে না, বরং বৈশ্বিক বাজারেও শক্ত অবস্থান করে নিতে পারবে।

এনএইচ/এমএএইচ/জিকেএস

Read Entire Article