একমাস, এক বছর, পাঁচ বছর কিংবা দশ বছর নয়; বেতন ছাড়াই ২১ বছর ছয়মাস কেটে গেছে রাজশাহীর এক কলেজ শিক্ষকের। তারপরও তিনি পাঠদান চালিয়ে গেছেন। অবশেষে তিনি এমপিওভুক্ত হতে পেরেছেন। আসছে ডিসেম্বরে তিনি নভেম্বর মাসের বেতন পাবেন।
ত্যাগী এই শিক্ষকের নাম মো. আবু তালেব। ২০০৩ সালের ৩ মে তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালীতে অবস্থিত আদর্শ ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ইনডেক্স না পাওয়ায় তিনি দুই দশক ধরে প্রভাষকই আছেন। এমপিওভুক্তির জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু লাভ হয়নি। অনেকটা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। অবশেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এমপিওভুক্ত হতে পেরেছেন।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর সম্প্রতি ইউএনও সোহরাব হোসেন এই কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আবু তালেবকে এমপিওভুক্ত করতে গত ৪ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার (মাউশি) আঞ্চলিক পরিচালকের মাধ্যমে মহাপরিচালকের কাছে একটি চিঠি দেন। এরপরই প্রভাষক আবু তালেবকে এমপিওভুক্ত করা হয়।
এই কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মো. রাশেদুজ্জামানের পদোন্নতিও আটকে ছিল দীর্ঘদিন। এ ছাড়া ইংরেজির শিক্ষক পলাশ মণ্ডলের আটকে ছিল ইনক্রিমেন্ট। ইউএনও সোহরাব হোসেন উদ্যোগী হয়ে রাশেদুজ্জামানকে প্রভাষক থেকে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছেন। লেকচারার পলাশ মণ্ডলের ইনক্রিমেন্ট সংক্রান্ত জটিলতাও দূর করেছেন। এই খুশিতে শিক্ষক আবু তালেব ও রাশেদুজ্জামান মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) ইউএনওর কার্যালয়ে গিয়ে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।
প্রভাষক আবু তালেব জানান, ২০০৩ সালে তিনি দর্শন বিভাগের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু এমপিওভুক্ত হতে না পেরে ২০১০ সালে তিনি মামলা করেন। ২০১১ সালে আদালত তার পক্ষে রায় দেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এর বিপরীতে আপিল করেন। ফলে তার এমপিওভুক্তি আটকে যায়। এরপর ২০২১ সালে সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে যে, কোনো বিভাগের পদ শূন্য হলে নতুন নিয়োগ দেওয়া যাবে না। অপেক্ষায় থাকা তৃতীয় শিক্ষককেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এরপর তিনি আবার এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করলেও তা আটকে থাকে।
তিনি বলেন, এই দীর্ঘ সময়ে বেতন না পেলেও আমি কোনোদিন কলেজে ফাঁকি দিইনি। শিক্ষার্থীদের পাঠদান করিয়েছি। ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার কষ্ট হয়েছে। জমি চাষ করে এবং গবাদিপশু পালন করে সংসার চালিয়েছি। দীর্ঘসময় পর ইউএনও মহোদয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে আমার এমপিওভুক্তি হয়েছে। এ জন্য আমি ইউএনও মহোদয়ের কাছে আজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ।
সম্প্রতি ইউএনও সোহরাব হোসেন মাউশির মহাপরিচালককে দেওয়া চিঠিতে লেখেন, ‘প্রভাষক আবু তালেব ২০০৩ সালের ৩ মে যোগদান করে অদ্যাবধি কর্মরত আছেন। অবসরজনিত কারণে পদ শূন্য হওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্তির জন্য পদ সমন্বয়ের সুযোগ চেয়ে নীতিমালা অনুযায়ী তিনি আবেদন করেছেন।’ তাকে এমপিওভুক্ত করার জন্য মহাপরিচালকের কাছে আবেদন জানান ইউএনও।
এই কলেজের অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন গত ৫ আগস্টের পর থেকে আর কলেজে যান না। যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, শিক্ষক আবু তালেবের বেতনের জন্য আবেদন করা হলে প্রত্যেকবার তা বাতিল করা হয়েছে। ওই সময় মন্তব্যের ঘরে লেখা হতো ‘উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা লাগবে’। তারপর তারা মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেন। তারপরেও বেতন হয়নি। এবার সাধারণভাবে আবেদন করে ইউএনওর সুপারিশের পর বেতন হয়েছে।
পবার ইউএনও এবং কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি সোহরাব হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমি কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি হয়ে প্রশাসনিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে আবু তালেবের এমপিওভুক্তির আবেদনটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিজেই ফরোয়ার্ডিং পত্রে স্বাক্ষর করি এবং তা মাউশির মহাপরিচালকের কাছে পাঠাই। মাউশি এই মানবিক বিষয়টি দ্রুত আমলে নিয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, যার ফলাফল হিসেবে শিক্ষক আবু তালেবের দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার অবসান হয়েছে। অন্য দুজনেরও জটিলতার অবসান হয়েছে। বিষয়টি আমাদের সবাইকে আনন্দে উদ্বেলিত করেছে।