৩০ বছরের অপেক্ষা, এবারও প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি

10 hours ago 4

সিলেটের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট নিয়ে সংসদীয় আসন সিলেট-৫। স্বাধীনতার পর মাত্র একবার এ আসনে বিএনপির এক নেতা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেটের ছয়টি আসনের মধ্যে শুধু এ আসনটি ছাড় দেওয়ার কারণে বিএনপির কোনো নেতা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি।

স্থানীয় বিএনপির সবচেয়ে বড় দুঃখ এটি। দেশে অনুষ্ঠিত ১৩টি সংসদ নির্বাচনে মাত্র তিনবার এ আসনে বিএনপি নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে। বাকি ১০টি নির্বাচনে এ আসনটি জোটের শরিকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে এ আসনে দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন তৎকালীন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাহির চৌধুরী।

এরপর দীর্ঘ ৩০ বছরে এ আসনে বিএনপির কোনো নেতা এ আসনে দলের মনোনয়ন পাননি। সর্বশেষ ২০১৮ সালেও এ আসনে জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুককে মনোনয়ন দেওয়ায় দলীয় নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বিএনপি নেতা মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন)।

দীর্ঘদিনের সে দুঃখ ঘুচাতে এবার বেশ তৎপর ছিলেন বিএনপি নেতারা। সবচেয়ে বেশি আশাবাদী ছিলেন সিলেট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মামুনুর রশীদ। মামুন ছাড়াও দলের মনোনয়ন পেতে মাঠে তৎপর বিএনপির আরও বেশ কয়েকজন নেতা। নিজেদের অস্তিত্বেও জানান দিতে দিনেরাতে সমানতালে কাজ করছেন তারা।

কিন্তু এবারও সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রাখায় হতাশ মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। এতে করে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। অনেকেও অতীতের ধারাবাহিকতার শঙ্কায় অনেকটা আশাহতও হয়েছেন। তবুও আশায় বুক বেঁধে মাঠ ছাড়ছেন না তারা।

এবার সিলেট-৫ আসন বিএনপির হাতছাড়া হলে সাংগঠনিক ক্ষতি পারে বলে জানিয়েছেন ভোটের মাঠে থাকা বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীরা। এমনকি মনোনয়ন দেওয়া না হলে নির্বাচনে দলকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মামুনুর রশীদ।

বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার আগ পর্যন্ত সিলেট-৫ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিচরণ ছিল এক রকম। প্রার্থী ঘোষণা পর সে পরিবেশ অনেকটা থমকে গেছে। এবারও কী সেই হতাশার গল্প নিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের। নাকি দলের নীতি নির্ধারকরা শেষ মুহূর্তে হলেও স্থানীয় বিএনপির এ দুঃখ বুঝবেন? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এ নির্বাচনি এলাকার বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, জোটের জন্য কোনো আসন ছাড়া হয়েছে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেই। দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপির সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের জন্য বিএনপি কয়েকটি আসন খালি রেখেছে। তবে খালি থাকা কোনো আসন ছাড় দেওয়া হবে, আর কোন আসনে নিজেদের প্রার্থী দেওয়া হবে তা নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত হবে। টার্গেট করে কোনো আসনকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে- এরকম কোনো কিছু নয়।

সুরমা ও কুশিয়ারার তীর ঘেঁষা জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-৫ আসনে স্বাধীনের পর থেকে চারবার আওয়ামী লীগ, তিনবার জাতীয় পার্টি, দুই বার স্বতন্ত্র ও একবার করে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। জোট হলে বিএনপির পক্ষ থেকে এ আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয় শরীকদের। বিএনপির সঙ্গে জোট করে একবার বিজয়ী হয়েছেন জামায়াতের প্রার্থী। কিন্তু কখনও জোটপ্রার্থী হওয়ার ভাগ্য হয়নি কোনো বিএনপি নেতার।

সিলেট-৫ আসন থেকে ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব আবুল হারিছ চৌধুরী। এরপর আসনটিতে বিএনপির জনপ্রিয় কোনো নেতা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাননি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন তৎকালীন সিলেট জেলা বিএনপি আব্দুল কাহির চৌধুরী। একই বছর অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ত্যাগী ও জনপ্রিয় কোন নেতা মনোনয়ন পাননি। পরে জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করে ধানের শীষ প্রতীক নেন এমএ মতিন চৌধুরী।

এরপর ৮ম ও ৯ম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কাছ থেকে আসনটি বাগিয়ে নেয় জোটসঙ্গী জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট করে সংসদে যান জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী। ২০০৮ সালে আবারও জোটের প্রার্থী হলেও বিজয় ধরে রাখতে পারেননি তিনি। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ফের আসনটি জোটসঙ্গী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে ছেড়ে দেয় বিএনপি। প্রার্থী হন মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। তাকে পরাজিত করে ৩য় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাফিজ আহমদ মজুমদার।

বারবার জোটের শরীকদের আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ বিএনপি নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে এমন দাবি উঠেছে জোরালোভাবে। কিন্তু এবারও হয়তোবা সেই একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আসন্ন নির্বাচনে এখন পর্যন্ত জোটের সিদ্ধান্ত না হলেও সিলেটের চারটি আসনের মধ্যে সিলেট-৪ ও সিলেট পাঁচ দুটি আসন খালি রেখেছে বিএনপি।

জোটের সিদ্ধান্ত কী হতে পারে সেটি এখন দেখার বিষয়। জোট সঙ্গীরা সিলেট-৪ নাকি সিলেট-৫ কোন আসন নিবে। নাকি দুটি আসন চায় তারা। এটি এখন আলোচনার বিষয়।

সিলেট-৫ আসনে জমিয়তের দলীয় প্রার্থী কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক। তিনি ২০১৮ সালে এ আসনে ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পাস করতে পারেননি। তখন এ আসনটি ছাড় দিয়েছিল বিএনপি।

দলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বিএনপির ৯ নেতা আসনটিতে এবার মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মামুনুর রশিদ (চাকসু মামুন)। ২০১৮ সালে দলের সিদ্ধান্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় এবার তিনি বেশ আশাবাদী। দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট দুই উপজেলাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সড়ক সংস্কার, নদী ভাঙনরোধ ও বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরব হয়ে তিনি নির্বাচনি এলাকার মানুষের মনজয়ের চেষ্টা করছেন।

পিছিয়ে নেই জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাপলুও। সমানতালে নির্বাচনের মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। এছাড়াও আসনটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন সিলেট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আশিক উদ্দিন চৌধুরী, সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির আহ্বায়ক জাকির হোসেন, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মাহবুবুল হক চৌধুরী, জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক ইকবাল আহমদ তাপাদার, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সহ-সভাপতি শরীফ আহমদ লস্কর, আবুল হারিছ চৌধুরী কন্যা ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় মহিলা দলের প্রচার সম্পাদক লুৎফা খানম চৌধুরী স্বপ্না।

সিলেট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন) বলেন, এবার আর কোনো ছাড় নয়। বারবার কেন এ আসন বিএনপিকে ছাড়তে হয়। স্থানীয় বিএনপি ও সাধারণ ভোটারদের আগ্রহকে গুরুত্ব না দিয়ে জোটের স্বার্থে এ আসনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এটা কোনোভাবে কাম্য না।

তিনি বলেন, এবারও যদি দল এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরা কোনো সহযোগিতা করবো না। এবার বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।

বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যারা রয়েছেন মাঠে আসনটিতে জামায়াতে ইসলাম দলটির জেলার নায়েবে আমির হাফিজ আনোয়ার হোসেন খানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীর ছেড়ে দেওয়া আসনটি পুনরুদ্ধারে তিনি নির্বাচনি এলাকায় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এছাড়া আসনটিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা রেজাউল করিম জালালী, খেলাফত মজলিস সিলেট জেলা শাখার উপদেষ্টা মুফতি আবুল হাসান, ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মুফতি ফয়জুল হক জালালাবাদী ও ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা রেজাউল করীম আবরার। এছাড়াও নির্বাচনি তৎপরতা শুরু না করলেও জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতা সাব্বির আহমদ, সাইফুদ্দিন খালেদ, এমএ মতিন ও এম জাকির হোসেন।

আহমেদ জামিল/আরএইচ/এএসএম

Read Entire Article