ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরপর আগুনের ঘটনায় দেশের মানুষ আতঙ্কে আছেন। মিরপুরের গুদাম থেকে শুরু হওয়া এ আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ল বন্দরনগরীর সিইপিজেড এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সেই আগুন এসে পৌঁছাল শাহজালাল বিমানবন্দরের গুরুত্বপূর্ণ কার্গো ভিলেজে। ধারাবাহিক আগুন লাগায় প্রশ্ন উঠছে, এসব নিছক কোনো দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত?
শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর আড়াইটার দিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে একে একে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট যোগ দেয়। ঘটনাস্থলে কাজ শুরু করে নৌ-বাহিনী, বিমানবাহিনী, সিভিল অ্যাভিয়েশন, বিজিবিসহ পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা। সন্ধ্যা নাগাদ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আগুন নেভেনি।
জানা গেছে, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানির কমপ্লেক্স ভবনে আগুন লেগেছে। এখানে আমদানি করা বিদেশি পণ্য রাখা হয়। আগুনে সেখানকার প্রায় সব মালামাল পুড়ে গেছে বলে জানা গেছে। এতে বড় ক্ষতির শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি) সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, আগুনে বিলিয়ন ডলারের (১০ হাজার কোটি টাকা) বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আমরা ধারণা করছি। এয়ার এক্সপ্রেস ইউনিট পুরোপুরি পুড়ে গেছে।’
বিমানবন্দরের সিঅ্যান্ডএফের (কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এক কর্মচারী বলেন, ‘কার্গোর সব কাপড়চোপড় ও কেমিক্যাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। আগামী দুই-তিন মাস হয়তো আমরা কোনো কাজই করতে পারব না।’
সপ্তাহের ব্যবধানে তিনটি বড় আগুনে পুড়ল গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এলাকা। ফায়ার সার্ভিস বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শর্টসার্কিট ও দাহ্য পদার্থের মজুতই প্রধান কারণ। কিন্তু বিমানবন্দরের ঘটনায় তারা এখনো নিশ্চিত নয় কোন জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত।
তবে সাধারণ মানুষ ৩টি আগুনের ঘটনার সময় ও স্থান নির্বাচনের মধ্যে ‘অস্বাভাবিক মিল’ থাকায় একে নিছক কাকতালীয় মনে করছেন না। রাজনৈতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত। জুলাই সনদ ঘোষণা, শেখ হাসিনার বিচার ও জাতীয় নির্বাচনের মতো বড় বড় ঘটনা থেকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করছে এই আগুন। এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় একের পর এক আগুনের ঘটনায় সরকারও অস্বস্তিতে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগার ঘটনা দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ হিসেবে দেখছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
ফেসবুক পোস্টে সারজিস আলম লিখেছেন, ‘স্বৈরাচারের দোসরদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে না পারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় ব্যর্থতা। যার ফল বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করতে হবে।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না। এগুলো স্বৈরাচারের দোসরদের দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ। তথাকথিত তদন্ত কমিটির নাটক বাদ দিয়ে এর পেছনের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা হোক।’
এদিকে, প্রতিটি ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস প্রাণপণ চেষ্টা করলেও অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব স্পষ্ট হয়েছে। মিরপুরে ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম অকেজো, চট্টগ্রামে রাসায়নিক মজুতের মানদণ্ড উপেক্ষিত, আর বিমানবন্দরে অ্যালার্ম সিস্টেম কাজ করেনি সময়মতো। আর বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনায় বেশ কয়েকজন ফায়ার ফাইটারকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে আগুনের ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লেখেন, ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত ও আক্রান্ত সবার প্রতি রইল আমার সহমর্মিতা ও প্রার্থনা। আশা করি সবাই নিরাপদে আছেন।’
আগুনের ঘটনায় দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাদের পেশাদারত্ব ও জনসেবার প্রতি নিষ্ঠা সত্যিই প্রশংসনীয়।
বারবার আগুনের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তে জোর দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লেখেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা—বিশেষ করে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের কারখানা ও মিরপুরের পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা জননিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা ও শৃঙ্খলা জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট করে দিচ্ছে।’
এদিকে আগুনের ঘটনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার হিসেবে এই বিমানবন্দর শুধু যাত্রী পরিবহনের কেন্দ্র নয়, বরং বাংলাদেশের ভাবমূর্তির এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। গত এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের দুই স্থানে—রাজধানীর মিরপুরে এবং চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায়— ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর আজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কি আকস্মিক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, এ ব্যাপারে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন।’
তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরের মতো এমন একটি কৌশলগত স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও নিরাপত্তা ঘাটতির এক স্পষ্ট প্রমাণ। এই ঘটনায় যদি কোনো গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা বা নাশকতার উপাদান থেকে থাকে, তবে তার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা সময়ের দাবি।’
পরপর আগুনের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা গভীরভাবে অবগত। আমরা সব নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই— নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।’
এতে বলা হয়, ‘নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।’
সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়েছে, এটি নাকি বড় কোনো নাশকতার অংশ। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সঠিক তথ্য ছাড়া আতঙ্ক না ছড়ানোই এখন সবচেয়ে জরুরি। সরকারি তথ্য দ্রুত প্রকাশ না হলে গুজবই সঠিক তথ্য হয়ে দাঁড়াবে, যা প্রশাসনের জন্য আরও বিপজ্জনক হতে পারে।
কখনো রাসায়নিকের আগুনে, কখনো অব্যবস্থাপনার আগুনে, কখনো আবার সন্দেহ ও গুজবের আগুনে। মিরপুর, চট্টগ্রাম, বিমানবন্দর— এই তিনটি নাম এখন একে অপরের প্রতিধ্বনি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন প্রশ্ন একটাই— এবার কোথায় আগুন লাগবে?
কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত আগুনের উৎস শুধু দেয়ালে খোঁজা হবে, সমাজের ভিতরে নয়— ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি ধোঁয়ার রেখা হয়তো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার আরেকটি নিদর্শন হিসেবেই আকাশে ভেসে থাকবে।