৫০ বছর পেরিয়েও প্রাসঙ্গিক কালজয়ী এই সিনেমাটি

1 month ago 11

১৯৭৫ সাল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তখনও গল্প বলার ধারা মূলত বিনোদন নির্ভর। ঠিক সেই সময়েই আলমগীর কবীর নিয়ে এলেন ‘সূর্যকন্যা’ সিনেমাটি। এটি এমন একটি সিনেমা, যা শুধু গল্প বলেই থেমে থাকেনি; বরং ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে সমাজ, রাজনীতি ও নারী-পুরুষের ক্ষমতার সম্পর্ককে গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছে।

এ বছর সিনেমাটি পেরিয়েছে ৫০ বছরের পথ। তবুও এর বক্তব্য আজও ততটাই তীক্ষ্ণ ও প্রাসঙ্গিক।‘সূর্যকন্যা’ ছবিতে লেনিন চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন প্রয়াত বুলবুল আহমেদ ও লাবণ্য চরিত্রে আছেন জয়শ্রী কবির। ছবিতে এই দুটি চরিত্র মন নিয়ে খেলে। তৈরি করে নানান বোধ। নাড়িয়ে যায় বুকের ভেতরের জগতটাকে। তাদের কথোপকথন যেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সময়ের এক সুদূর অতীতে। সেখানে লাবণ্য বলেন, ‘একসময় নারী ছিল স্বাধীন, আনন্দময় জীবনের অংশীদার। কিন্তু শক্তিতে মত্ত পুরুষ ধীরে ধীরে তাদের বন্দি করে রেখেছে অন্ধকারে।’ এই সংলাপগুলো নিছক কথোপকথন নয়, বরং নারী নিপীড়নের ইতিহাসের প্রতীকী পুনরাবৃত্তি।

আলমগীর কবীর লাবণ্যকে দেখিয়েছেন একটি ম্যানিকুইন বা পুতুল হিসেবে। যার নিজের ইচ্ছা নেই, যা সাজিয়ে রাখা হয় অন্যের চোখের আনন্দের জন্য। এই প্রতীকের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে প্রায়শই স্বাধীন সত্তা থেকে সরিয়ে এনে ভোগ্যপণ্য বানানো হয়।

লেনিন, ধনাঢ্য বাবার ছেলে হলেও প্রচলিত সাফল্যের সংজ্ঞায় ফেলতে না পারা একজন মানুষ। ডাক্তার ছোট ভাইয়ের কটাক্ষ, পরিবারের অবহেলা এসবের মাঝেও তিনি বেঁচে থাকেন সাম্যবাদী স্বপ্নে। কল্পনায় রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চারণ করেন। সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। তার শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অস্ত্র।

লেনিনের চরিত্র শুধু রাজনৈতিক ভাবনায় ভরপুর নয়, এতে রয়েছে গভীর মানবিকতা। তিনি বড় ভাইয়ের মতো শাসন করেন না; বরং ছোট বোনের প্রেমের বার্তাও পৌঁছে দেন প্রিয়জনের কাছে, যদিও সেই প্রেমিক অর্থহীন, প্রতিষ্ঠাহীন এক কবি। তার কাছে কবিতার সৌন্দর্যই বড়, বৈষয়িক সাফল্য নয়।

লেনিনের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে রাসেলকে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আহসান আলী সিডনী। তিনি একজন ব্যবসায়ী, যিনি নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরেট প্রতীক। দোকানের সহকারী ম্যানেজার মনিকা চরিত্রে রাজশ্রী বোস তার প্রেমে পড়ে, কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গে এসে রাসেলের আসল চেহারা প্রকাশ পায়। তার চোখে বিয়ে মানে দায়িত্বের ঘানি, আর নারী মানে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। মনিকা সেই অপমান মেনে নেয় না; নিজের স্বাবলম্বিতার পথে হাঁটে।

সিনেমার অন্যতম অভিনব দিক ছিল অ্যানিমেশনের ব্যবহার। যেখানে মানব সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর স্বাধীনতা কীভাবে ক্ষীণ হয়েছে, তা তুলে ধরা হয়। সেই সময়ের বাংলা সিনেমায় এমন প্রতীকী ও পরীক্ষাধর্মী উপস্থাপনা ছিল বিরল।

গানের মধ্যেও পাওয়া যায় এই প্রতীকের প্রতিধ্বনি। ‘আমি যে আঁধারের বন্দিনী’- গানটিতে পুতুল থেকে জীবন্ত মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেন নারীর মুক্তির চিরন্তন আহ্বান হয়ে ওঠে। আজও এই গান পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবহেলার কথা বলার প্রতীক।

সবমিলিয়ে ‘সূর্যকন্যা’ শুধু একটি প্রেমের গল্প নয়; এটি নারীর মুক্তি, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সমালোচনা ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার এক শিল্পিত ঘোষণা। ৫০ বছর পরও সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম, সংলাপ ও প্রতীক আজও বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়।

আলমগীর কবীরের এই কালজয়ী সৃষ্টি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সময় বদলায়, প্রযুক্তি এগোয়, কিন্তু নারী-পুরুষ সমতার প্রশ্নে এখনও লড়াই বাকি। ‘সূর্যকন্যা’ সেই লড়াইয়েরই এক শিল্পময় দলিল। সময় করে দেখে নিতে পারেন সিনেমাটি।

এলআইএ/এমএমএফ/জিকেএস

Read Entire Article