৬০০ কোটি টাকার মেরিন পেইন্টের বাজারে বাধা শুল্ক-করের বোঝা

1 hour ago 3

কোভিড ও বৈশ্বিক মন্দায় একসময় স্থবির হয়ে পড়া বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প ২০২২ সাল থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে মেরিন পেইন্টসহ সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোর বাজারেও তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা। বর্তমানে দেশে মেরিন পেইন্টের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬শ কোটি টাকায়, যার সিংগভাগই আমদানিনির্ভর।

উদ্যোক্তারা বলছেন, উচ্চ শুল্ক ও করের কারণে দেশীয় পেইন্ট উৎপাদকরা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছেন না। ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশাল এই বাজার এখনো ‘অধরা’।

২০০৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ প্রথমবারের মতো ডেনমার্কে জাহাজ রপ্তানি করে দেশের জাহাজ নির্মাণখাতে নতুন যুগের সূচনা করে। এরপর ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর জার্মানিতে সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ৪৪টি জাহাজ রপ্তানি হয়েছে, যার মধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিন একাই ৩৩টি জাহাজ রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুন

বিদেশি ব্র্যান্ডের দখলে মেরিন পেইন্টের বাজার
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলবে বাড়তি বন্দর মাশুল
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া এফটিএ হলে খুলবে আসিয়ানে রপ্তানির দুয়ার

সমুদ্রগামী এসব জাহাজে দীর্ঘ স্থায়ীত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মেরিন পেইন্ট অপরিহার্য। লবণাক্ত পানি, শৈবাল, জং ও আর্দ্রতা থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয় অ্যান্টি-ফাউলিং পেইন্ট। এছাড়া রয়েছে- টপসাইড পেইন্ট (জাহাজের ওপরের অংশে), নন-স্কিড ডেক পেইন্ট (ডেকে ব্যবহৃত হয়, পিছলানো রোধে), অ্যান্টি-করোজন কোটিং, প্রাইমার, বিলজ পেইন্টস, ব্যারিয়ার কোট ইত্যাদি। এই পেইন্টগুলো সাধারণত অ্যাপোক্সি ও পলিউরেথেনভিত্তিক হয়, যা সমুদ্রের কঠিন পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা দেয়।

কাঁচামালের উচ্চ শুল্ক ও করের কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। শুল্কসহ আমাদের ১ টাকার কাঁচামালে খরচ পড়ে ২ টাকা ১০ পয়সার বেশি। ফলে আমাদের রং বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না।- বিপিএমএর সাধারণ সম্পাদক অরুণ মিত্র

দেশে উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বাধা শুল্ক-কর

বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ) জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে চার হাজার ৫৩ মেট্রিক টন মেরিন পেইন্ট উৎপাদন হয়েছে, যার বাজারমূল্য ১৬০ কোটি টাকা। কিন্তু এ বাজারে দেশীয় পেইন্টের অংশগ্রহণ মাত্র ২ শতাংশ।

বিপিএমএর সাধারণ সম্পাদক ও নিপ্পন পেইন্টস বাংলাদেশের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার অরুণ মিত্র জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা মেরিন রং উৎপাদনের সক্ষমতা রাখি, কিন্তু কাঁচামালের উচ্চ শুল্ক ও করের কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। শুল্কসহ আমাদের ১ টাকার কাঁচামালে খরচ পড়ে ২ টাকা ১০ পয়সার বেশি। ফলে আমাদের রং বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না।’

তিনি বলেন, ’২৬ শতাংশের বেশি সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি ও ভ্যাট, আর কাঁচামালে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক ও কর দিতে হয়। সব মিলিয়ে দিতে হয় ১০১ শতাংশ শুল্ক ও কর। সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য আমদানি করা রং শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও সেসব রং পরে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ায় উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের কাছে মানসম্পন্ন প্রযুক্তি ও উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। তবুও তারা বিদেশি রঙের কম মূল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। ফলে দেশের অনেক পেইন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবসা চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে।- ইম্পেরিয়াল পেইন্টসের চেয়ারম্যান ডা. নুরুজ্জামান

উদ্যোক্তারা মেরিন পেইন্টসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ও কর কমানো, সরকারি টেন্ডারে দেশীয় পেইন্টকে অগ্রাধিকার, ভোক্তাপর্যায়ে সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করতে ট্যাক্স কাঠামো পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান।

ইম্পেরিয়াল পেইন্টসের চেয়ারম্যান ডা. নুরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের কাছে মানসম্পন্ন প্রযুক্তি ও উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। তবুও তারা বিদেশি রঙের কম মূল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। ফলে দেশের অনেক পেইন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবসা চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতি মাসেই আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসছি। তাদের সমস্যার কথা শুনছি, সমাধান করা চেষ্টা করছি। ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক চাওয়া আমরা পূরণ করছি। অবশ্যই আমরা দেশি শিল্পকে সুরুক্ষা দেবো।’

বাজারের বর্তমান চিত্র অনুযায়ী, নরওয়ের জতুন ও ডেনমার্কের হ্যাম্পেল ব্র্যান্ডের মেরিন পেইন্ট সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। জতুন মালয়েশিয়া বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করেছে। স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে সহজলভ্য হওয়ায় বাজারে তাদের প্রভাব বেশি।

আমরা বার্জার ও জতুন রং ব্যবহার করি। এখনো দেশীয় পেইন্ট আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছায়নি বলেই আমদানিনির্ভরতা বেশি।- শাহ আমানত ডকইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন বকুল

চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাহাজ নির্মাণে প্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রী এখন আমরা দেশীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করি। তবে বায়াররাই এলসি করে রংসহ কিছু বিশেষায়িত সামগ্রী আমদানি করেন। রঙের ক্ষেত্রে জতুন, হ্যাম্পেল—এই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোই বেশি জনপ্রিয়।’

শাহ আমানত ডকইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন বকুল বলেন, ‘আমরা বার্জার ও জতুন রং ব্যবহার করি। এখনো দেশীয় পেইন্ট আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছায়নি বলেই আমদানিনির্ভরতা বেশি।’

এফএমএস মেরিন সার্ভিসের সিইও ইঞ্জিনিয়ার এস এম সানোয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাহাজে পেইন্ট সরবরাহের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টরাই নির্ধারণ করেন কোন ব্র্যান্ড ব্যবহার হবে। বেশিরভাগ সময় তারা জতুন পছন্দ করেন।’

এসএম/এএসএ/এমএস

Read Entire Article