বাংলা ব্যান্ডসংগীতের প্রবাদপ্রতীম তারকা ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। শ্রোতাদের উন্মদনা জাগানো গানের পাশাপাশি তিনি বেশ কয়েকটি কষ্টের গান গেয়েছেন। ‘আসলে কেউ সুখী নয়’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’সহ আরও কিছু কষ্টের গান শ্রোতাদের হৃদয়ের অতল ছুঁয়েছে। তবে ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’ গানটি যেন সব গানকে ছাপিয়ে গেছে। এ গানটি শোনার পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে- ‘আসলেই কি আইয়ব বাচ্চু কষ্ট পেতে ভালোবাসতেন?
আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল—এমন বেশ কয়েকজন গীতিকার, সুরকারের ভাষ্য, আইয়ুব বাচ্চু ভীষণ অভিমানী মানুষ ছিলেন। অন্তরে অভিমান পুষে রাখতেন। কখনো কখনো কেঁদেছেন। তার সারল্য ছিল শিশুর মতো। আজ (১৬) এই কষ্ট পেতে ভালোবাসা, অভিমান পুষে রাখা মানুষটির জন্মদিন।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে জন্মেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তার বাবার প্রত্যাশা ছিল- ছেলের এমন একটা নাম হবে, যা অন্য কারও সঙ্গে মিলবে না। সেই নামে সবাই তাকে চিনবে। বাবার সেই চাওয়া কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল। দেশের সবাই তাকে এক নামে চিনেছিলেন।
আইয়ুব বাচ্চু মা-বাবার ভীষণ আদরের ছেলে ছিলেন। কিন্তু তিনি শৈশব হতে পারিবারের কাছ থেকে সংগীতচর্চার জন্য অনুকূল পরিবেশ পাননি। বাবা চাইতেন লেখাপড়া করে তার ব্যবসায় মন দেবে ছেলে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আইয়ুব বাচ্চু বোহেমিয়ান স্বভাবের ছিলেন। বাবার ব্যবসায় মন বসে না, মনোযোগ দিতে পারেননি লেখাপড়াতেও।
যিনি গিটারের জাদুকর হয়ে সবার অন্তর জয় করবেন তাকে কি আর গতানুগতিক কোনো কাজ আটকাতে পারে? তাইতো তিনি সুরের টানে ঘর ছেড়েছিলেন। আইয়ুব বাচ্চু মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন। প্রথমে উঠেছিলেন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে। এরপর বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তারকা হয়ে উঠলেন তিনি। প্রচণ্ড প্রতিভা আর কঠোর অনুশীলন তাকে মহাতারকায় পরিণত করে। তার গিটারের ঝংকারে বিদ্যুৎ তরুণ-তরুণীদের শিরা-উপশিরায় বয়ে যেত। অনুরাগীরা আইয়ুব বাচ্চুকে ‘বস’ বলে সম্বোধন করতেন।
আইয়ুব বাচ্চু মূলত রক ঘরানার গান গাইতেন। তবে তিনি শুধু রক বা ব্যান্ডের গানে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। আধুনিক গান, লোকগীতি দিয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন এ তারকা। লোকগান নিয়ে একটি অ্যালবাম রিমেক করেছেন তিনি এবং সেখানে শ্রোতাদের কাছ থেকে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন। চলচ্চিত্রের গানে তিনি পেয়েছিলেন বিপুল জনপ্রিয়তা। যদি তিনি চলচ্চিত্রে খুব অল্প গান করেছিলেন। কিন্তু সেই অল্প কয়েকটি গানই শ্রোতারা দারুণভাবে গ্রহণ করেছেন।
আইয়ুব বাচ্চুকে নতুন প্রজন্মের শ্রোতারা মূলত ‘এলআরবি’ ব্যান্ডের দলনেতা হিসেবেই জানেন। কিন্তু এলআরবির আগে অন্য যেসব ব্যান্ডে ছিলেন, তা থেকে বারবারই তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সবশেষ ‘এলআরবি’র আগে তিনি সোলস ব্যান্ডে ছিলেন। এই ব্যান্ড থেকেও একবার বেরিয়ে এসেছিলেন। শেষমেশ অভিমান নিয়ে ছেড়েছিলেন। সোলস ছেড়ে ১৯৯০ সালের ৫ এপ্রিল নিজের ব্যান্ড দল প্রতিষ্ঠা করলেন আইয়ুব বাচ্চু, যার নাম রাখলেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরে এর নাম পরিবর্তন করে ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’ রাখা হয়। সেই বছরই ‘এলআরবি’ তাদের যাত্রা শুরু করে একটি ডাবল অ্যালবাম দিয়ে, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ডাবল অ্যালবাম।
আইয়ুব বাচ্চু তার সংগীত ক্যারিয়ারে অনেক কালজয়ী উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘মেয়ে’, ‘সুখের এ পৃথিবী,’ ‘ফেরারি মন,’ ‘উড়াল দেবো আকাশে’, ‘বাংলাদেশ’, ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘এক আকাশের তারা’, ‘সেই তারা ভরা রাতে’, ‘কবিতা, ‘তিন পুরুষ’, ‘যেওনা চলে বন্ধু’, ‘বেলা শেষে ফিরে এসে’, ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’প্রভৃতি।
এমএমএফ/জেআইএম