পৃথিবীতে মানুষ শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ধাপেই সুস্থতা-অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যায়। জীবনের পড়ন্ত বেলায় অসুস্থতার পরিমাণ বেড়ে যায়। মানুষের এই সুস্থতা-অসুস্থতা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। তিনি বান্দাকে সুস্থতার নেয়ামত দান করেন, যেন বান্দা প্রতিটি কাজকর্মে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করে। পক্ষান্তরে অসুস্থতার পরীক্ষায়ও অবতীর্ণ করেন, যেন বান্দার গুনাহ মার্জনা কিংবা মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ হয়। কেউ অসুস্থ হলে অসহায়ত্ব বোধ করে। শারীরিক দুর্বলতা তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। ওঠাবসা, খাবার-দাবারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সেবার প্রয়োজন হয়। আরও প্রয়োজন হয় দুটি কথা বলে তাকে অভয় দেওয়ার। অসুস্থতায় ধৈর্য ধারণ করার প্রতিদানসহ বিভিন্ন সান্ত্বনার বাণী শোনানোর। অসুস্থ ব্যক্তির সেবা ও দেখাশোনার অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে কোরআন ও হাদিসে। পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে রোগী দেখার আদব ও শিষ্টাচার
আল্লাহর নৈকট্য লাভ
অসুস্থ ব্যক্তির সেবার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রতিদান ও তাঁর নৈকট্য লাভ হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ কেয়ামতের দিন বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমার খোঁজখবর রাখোনি। সে বলবে, হে আমার রব! কীভাবে আপনার খোঁজখবর রাখব, আপনি তো সারা জাহানের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, আর তুমি তার সেবা করোনি? তুমি কি জানতে না যে তুমি তার সেবা করলে তার কাছেই আমাকে পেতে?’ (মুসলিম : ২৫৬৯)
আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়
রোগীর সেবা-শুশ্রূষাকারীর ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে। সে যেন রহমতের মধ্যে ডুবে থাকে। হজরত ওমর (রা.) বলেন, আমি জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গেল, সে আল্লাহর রহমতে প্রবেশ করল যতক্ষণ না সে বসে। যখন সে রোগীর পাশে বসল সে রহমতের মধ্যে স্থির হয়ে গেল।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ : ১৮৪)
ফেরেশতাগণের ক্ষমাপ্রার্থনা
ফেরেশতাগণ রোগীর সেবা-শুশ্রূষাকারীর জন্য ক্ষমা ও মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকেন। হজরত সুয়াইর, তার পিতা আবু ফাখেরা থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, একবার আলী (রা.) আমার হাত ধরে বললেন, আমার সঙ্গে চলো হোসাইন অসুস্থ, তাকে দেখে আসি। আমরা গিয়ে তার কাছে আবু মুসা আশআরী (রা.)-কেও পেলাম, আলী (রা.) বললেন, আবু মুসা! রোগী দেখার উদ্দেশ্যে এসেছিলে না এমনি বেড়াতে এসেছিলে? তিনি বললেন, না, রোগী দেখার নিয়তে এসেছি। আলী (রা.) বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কোনো মুসলমান যদি কোনো মুসলমান রোগীকে দেখতে যায় তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা দোয়া করে। আর তার জান্নাতে একটি ফলের বাগন হবে। (তিরমিজি : ৯৬৯)
আল্লাহর নিরাপত্তা লাভ
রোগীর সেবাকারী আল্লাহর জিম্মায় থাকে। হজরত মুয়াজ (রা.) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) পাঁচটি বিষয়ে আমাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন। যে ব্যক্তি কোনো একটা করবে সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে-১. যে রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করে ২. জানাজা নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে খাটিয়ার সঙ্গে চলে ৩. যুদ্ধের জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হয় ৪. সম্মান-শ্রদ্ধা জানাতে কোনো ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর সামনে উপস্থিত হয় অথবা ৫. লোকদের থেকে আলাদা হয়ে ঘরে বসে থাকে, ফলে লোকেরা তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে। আর সে ব্যক্তিও তাদের কষ্ট থেকে বেঁচে থাকে। (মুসনাদে আহমদ : ২২০৯৩)
জান্নাতে আবাসন নির্মাণ
রোগীর সেবা-শুশ্রূষাকারীকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে স্থান দান করবেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন কোনো মুসলমান তার অসুস্থ ভাইয়ের সেবা-শুশ্রূষা করে বা তার সঙ্গে দেখা করে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, তুমি ভালো কাজ করেছ, তোমার পথকে মসৃণ করেছ এবং জান্নাতে তোমার ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছ। (মুসনাদে আহমদ : ৮৫৩৬)
রোগীর জন্য দোয়া করা
রোগীর জন্য সুস্থতার দোয়া করা। প্রয়োজনে কুরআন-হাদিসের দোয়া দ্বারা তাকে ঝাড়ফুঁক করা। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, আমাদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসুল (সা.) তার ডান হাত দিয়ে তাকে মুছে দিতেন। এরপর বলতেন ‘আযহিবিল রাঅসা রব্বান নাস ওয়াশশাফি আনতাশ শাফি লা শিফাআ ইল্লা শিফাউকা শিফাআন লা-ইউগাদিরু ছাকমা অর্থাৎ হে মানব জাতির প্রতিপালক! সংকট দূর করে দিন। আর আরোগ্য ও নিরাময় দান করুন, আপনিই নিরাময়কারী। আপনার শেফা ও নিরাময় ব্যতীত আর কোনো (বাস্তব নির্ভরযোগ্য) শেফা নেই। এমন নিরাময় করুন, যার পরে কোনো রোগব্যাধি অবশিষ্ট থাকে না। (মুসলিম : ২১৯১)
রোগীকে আশান্বিত করা
রোগীকে হতাশ না করে তার জীবন সম্পর্কে আশা জাগানো। তিনি আরও নেক হায়াত পাবেন, ভালো ভালো কাজ করে যেতে পারবেন ইত্যাদি বলে তাকে আশান্বিত করা। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোনো রোগীর কাছে গেলে তাকে তার জীবন সম্পর্কে আশা প্রদান করবে। এতে অবশ্য তাকদিরে যা আছে তার কিছুই প্রত্যাখ্যাত হবে না। কিন্তু তার মন প্রফুল্ল হবে।’ (তিরমিজি : ২০৮৭)
অসুস্থ ব্যক্তির চাহিদা পূরণ করা
রোগীর কোনো চাহিদা আছে কি না সেটা জিজ্ঞাসা করা। খাবার বা অন্য কোনো বৈধ চাহিদা থাকলে সেটা যথাসম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করা। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, নবীজি (সা.) একজন অসুস্থ ব্যক্তির সেবার জন্য তার কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, তুমি কি কিছু (খেতে) চাও? সে বলল, আমি পিঠা খেতে চাই। তিনি বললেন, ঠিক আছে। তখন তারা (সাহাবিগণ) তার জন্য তা খুঁজে আনলেন (ইবনে মাজাহ : ১৪৪০)। এ ছাড়া রোগীর নির্দিষ্ট সময়সূচিতেই সাক্ষাৎ করা। তার কাছে অবস্থান দীর্ঘ করা না করা, যাতে তার ঘুম-বিশ্রাম ও খাবারে কষ্ট হয়। তাকে কোনো বিষয়ে বেশি প্রশ্ন না করা ইত্যাদি। এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখে রোগীর সেবা করা।
তাই আমরা রোগী সেবার এ ইবাদতটিতে আরও মনোযোগী হব। পরিবার থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ যারাই অসুস্থ হবে, আমরা তাদের দেখাশোনা ও সেবা-শুশ্রূষা করব। ইবাদত ও মানবসেবার মাধ্যমে জীবনকে অর্থময় করে তুলব। মহান আল্লাহর দরবারের অফুরন্ত প্রতিদানে নিজেদের ধন্য করব। আল্লহ তায়ালা তওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব