গণভোট কি জুলাই সনদকেই অনিশ্চিত করে দেবে?

গণভোটে ‘না’ ভোট দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। তিনি বলেছেন, ‘এবার ভোটারদের হাতে দুইটা ব্যালট থাকবে। একটি হবে ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লাসহ বিভিন্ন প্রতীকে। আরেকটি হবে গণভোটের, “হ্যাঁ” বা “না”। আমাদের নেতারা আপনাদের বুঝিয়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে “না” হবে।’ গত ১৪ নভেম্বর বিকালে নোয়াখালী-২ আসনের সেনবাগ উপজেলার ডমুরুয়া আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ের মহিলা দলের প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন জয়নুল আবদিন ফারুক। (প্রথম আলো, ১৪ নভেম্বর ২০২৫)। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে এ বছরের গণভোটের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষরিত হয় জুলাই জাতীয় সনদ—যেখানে ৮৪টি সুপারিশ ও ৭টি অঙ্গীকার রয়েছে। এসব সুপরিশের মধ্যে অনেকগুলো প্রস্তাব সরাসরি সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিছু কিছু প্রস্তাব সংবিধানের মৌলিক কাঠামো যেমন সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের সঙ্গেও সম্পর্কিত। তার মানে

গণভোট কি জুলাই সনদকেই অনিশ্চিত করে দেবে?

গণভোটে ‘না’ ভোট দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। তিনি বলেছেন, ‘এবার ভোটারদের হাতে দুইটা ব্যালট থাকবে। একটি হবে ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লাসহ বিভিন্ন প্রতীকে। আরেকটি হবে গণভোটের, “হ্যাঁ” বা “না”। আমাদের নেতারা আপনাদের বুঝিয়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে “না” হবে।’ গত ১৪ নভেম্বর বিকালে নোয়াখালী-২ আসনের সেনবাগ উপজেলার ডমুরুয়া আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ের মহিলা দলের প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন জয়নুল আবদিন ফারুক। (প্রথম আলো, ১৪ নভেম্বর ২০২৫)।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে এ বছরের গণভোটের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন।

প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষরিত হয় জুলাই জাতীয় সনদ—যেখানে ৮৪টি সুপারিশ ও ৭টি অঙ্গীকার রয়েছে। এসব সুপরিশের মধ্যে অনেকগুলো প্রস্তাব সরাসরি সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিছু কিছু প্রস্তাব সংবিধানের মৌলিক কাঠামো যেমন সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের সঙ্গেও সম্পর্কিত। তার মানে জুলাই সনদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দলিল—যেখানে সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও সংসদের গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি বিরোধী দল থেকে নিয়োগ; একই ব্যক্তির দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা; একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকা; সংসদে এমপিদের বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মতো বিষয়ও রয়েছে।

যদি সংসদ অনুমোদন না করে, তাহলে কী হবে? প্রশ্ন হলো, অভ্যুত্থানের পরেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি এই বোঝাপড়া ও আস্থার সম্পর্কটি তৈরি না হয়, তাহলে এক বছরের বেশি সময় ধরে যে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটি কি ফাঁকা বুলি? কেন একটি নির্দলীয় সরকার এবং এই নির্দলীয় সরকারের প্রধানের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপনে ব্যর্থ হলো, সেই প্রশ্নের সুরাহা করাও জরুরি।

সুতরাং এরকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সব দলের ও জনগণের মতামতের ভিত্তিতে অনুমোদিত হবে—এটাই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু দেখা গেলো, এই ৮৪টি সুপারিশের সবগুলোর সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সমর্থন নেই। যে কারণে তারা এসব সুপারিশে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি দিয়েছে। যদিও সেই নোট অব ডিসেন্টগুলো বাদ দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত ১৩ নভেম্বর এই সনদ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতির পক্ষে যে আদেশ জারি হয়েছে, সেখানে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে জুলাই সনদের ওপর গণভোট নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের দিনে প্রত্যেক ভোটারের হাতে দুটি ব্যালট পেপার দেয়া হবে। একটিতে তিনি জাতীয় নির্বাচনে তার পছন্দের প্রতীকে ভোট দেবেন। আরেকটি ব্যালটে হ্যাঁ বা না।

সংকট তৈরি হয়েছে এখানেই। কেননা কোনো ভোটার যদি জুলাই সনদের ওপরে দেয়া চারটি প্রশ্নের মধ্যে দুটির সঙ্গে একমত হন আর দুটি সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন, তাহলে তিনি কি ‘হ্যাঁ’ ভোট দেবেন নাকি ‘না’? যদি হ্যাঁ ও না উভয় ঘরে টিক চিহ্ন দেন তাহলে ভোট বাতিল হয়ে যাবে। যে কারণে জুলাই সনদ ও গণভোট নিয়ে মোটা দাগে দুটি প্রশ্ন উঠেছে। ১. চারটি প্রশ্নের উত্তরে একটি হ্যাঁ বা না ভোটের এই ধারণা কতটা যৌক্তিক এবং ২. জুলাই সনদের ৮৪টি প্রস্তাব ও ৭টি অঙ্গীকারের ওপর যে গণভোট হবে, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কতটা জানে? একজন সাধারণ কৃষক, গৃহিণী বা রিকশাচালক বা কম পড়ালেখা জানা মানুষ জুলাই সনদের ভারী ভারী কথা পড়ে বুঝবে বা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কেউ তাদের বোঝাবে?

এর পাশাপাশি গণভোট নিয়ে আরও কিছু প্রশ্নের সুরাহা করা জরুরি। যেমন:

ক. একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে ভোটদানে কত সময় লাগবে? সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটের যে সাধারণ সময়সীমা, সেই সময়ের মধ্যে কি ভোট শেষ করা যাবে?

খ. ভোট গণনায় কত সময় লাগবে। অতীতে যেমন ভোটগ্রহণের পরদিন সকালের মধ্যেই চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে, এবার একই দিনে গণভোট হওয়ায় সেই সময়ের মধ্যে কি জাতীয় নির্বাচনের ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা যাবে?

গ. কোন প্রক্রিয়ায় ভোটগ্রহণ ও গণনা করা হবে? এজন্য নির্বাচন গ্রহণকারীদের যে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, সেটি কি আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের আগে সম্পন্ন করা যাবে?

ঘ. প্রতিটা বুথে কী দুটি করে টিম কাজ করবে? তাহলে বুথে কর্মীর সংখ্যা হবে প্রায় দ্বিগুণ। এত জনবল নির্বাচন কমিশনের আছে কি না। বলা হচ্ছে, বিগত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন লোকদের এবার দায়িত্ব দেয়া হবে না। ওই জনবল বাদ দিয়ে কি একই দিনে জাতীয় সংসদ ও গণভোটের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মতো পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নির্বাচন কমিশনের আছে বা এই সময়ের মধ্যে তাদের প্রশিক্ষিত করা যাবে?

ঙ. একই দিনে দুটি নির্বাচন হলে এর গণনার পদ্ধতি কী হবে এবং কোন নির্বাচনের ফলাফল আগে ঘোষণা করা হবে, জাতীয় নির্বাচনের নাকি গণভোটের?

নির্বাচন কমিশনের কাছে নিশ্চয়ই এসব প্রশ্নের উত্তর আছে। এ বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া জরুরি।

এবার আসা যাক গণভোটের আরেকটি জটিল প্রশ্নে। সেটি হলো, যেহেতু চারটি প্রশ্নে একটি হ্যাঁ বা না দিতে হবে, ফলে সেখানে কি আসলেই প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটবে? সবাই কি বুঝে ভোট দেবে? বিপুলসংখ্যক ভোটার যদি না বুঝে হ্যাঁ বা না ভোট দেয়, তার ফলাফল কী হবে? আবার যারা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে যাবেন, তাদের সবাই কি গণভোটে ভোট দেবেন? যদি না দেন তাহলে কি হবে?

জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে গেলে গণভোটের ব্যালটে সিল মারাও কি বাধ্যতামূলক? নিশ্চয়ই এট বাধ্যতামূলক হবে না। তার মানে জাতীয় নির্বাচনে যে পরিমাণ ভোট পড়বে, গণভোটে সেই পরিমাণ ভোট নাও পড়তে পারে। অতীতের তিনটি গণভোট সম্পর্কে বলা হয় যে, ওই ভোটগুলোয় যে পরিমাণ ভোট পড়েছ বলে দাবি করা হয়, বাস্তবে তার এক তৃতীয়াংশ লোকও ভোট দিতে যায়নি। প্রশ্ন হলো, এবারও কি তাই হবে? নাকি জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হওয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণভোটে জনঅংশগ্রহণ অতীতের তিনটি নির্বাচনের চেয়ে বেশি হবে? বিএনপি কি এ কারণেই একই দিনে গণভোটের পক্ষে? তবে উল্টোও হতে পারে।

যেমন- গণভোটে অর্ধেকের বেশি ভোট না-এর ঘরে পড়লে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। যেহেতু বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট আমলে না নিয়ে জুলাই সনদ অনুমোদনের সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, অতএব বিএনপি ভেতরে ভেতরে না ভোটের ক্য্যাম্পেইন করতে পারে—যার কিছুটা ইঙ্গিত এরইমধ্যে জয়নুল আবদিন ফারুক দিয়েছেন। সুতরাং বিএনপির ভোটাররা যদি সত্যিই গণভোটে না-এর ঘরে টিকচিহ্ন দেন, তাহলে বাকি দলগুলোর ভোটারদের ভোটেই কি হ্যাঁ জয়যুক্ত হবে?

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না—এটি সরকারের তরফে এরইমধ্যে স্পষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলেও আওয়ামী লীগ যে বিলীন হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক অনেক ঘটনা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব নাশকতা হচ্ছে, সেজন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এরইমধ্যে হুমকি দিয়েছে যে, তারা নির্বাচন প্রতিহত করবে। যদি তারা জাতীয় নির্বাচন প্রতিহত করতে না পারে তখন স্বভাবতই গণভোটে না-এর পক্ষে প্রচার চালাবে। কারণ গণভোটে হ্যাঁ জিতে গেলে জুলাই সনদ অনুমোদনের দরজা খুলে যাবে—যেখানে অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি রয়েছে।

এটি হয়ে গেলে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা বা পরাজয় হবে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি ভেতরে ভেতরে ‘না’ ভোটের ক্যাম্পেইন করে এবং সত্যিই তাদের ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে না ভোট দিয়ে আসে, তা সঙ্গে যদি বিএনপির ‘না’ ভোট যুক্ত হয়, তাহলে ভোটের ফলাফল কী হবে, সেটি সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিসহ জুলাই সনদ অনুমোদন এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংসদ এই সনদ অনুমোদন না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে বলে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির স্পষ্ট দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপি এখন আর জুলাই সনদ স্বীকার করে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন।

কিন্তু এই সনদটি যদি সত্যিই একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের দলিল হতো এবং আগে সংসদে এবং তারপরে গণভোটে দিয়ে এটি অনুমোদনের বিধান করা হতো, তাহলে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতো না। কিন্তু আগে সংসদে এবং তারপরে গণভোটে না দেয়ার পক্ষে জামায়াত ও এনসিপির যুক্তি হলো, যদি সংসদ অনুমোদন না করে, তাহলে কী হবে? প্রশ্ন হলো, অভ্যুত্থানের পরেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি এই বোঝাপড়া ও আস্থার সম্পর্কটি তৈরি না হয়, তাহলে এক বছরের বেশি সময় ধরে যে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটি কি ফাঁকা বুলি? কেন একটি নির্দলীয় সরকার এবং এই নির্দলীয় সরকারের প্রধানের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপনে ব্যর্থ হলো, সেই প্রশ্নের সুরাহা করাও জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/এএসএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow