বই ছাপার জামানতের অর্থছাড়েও এনসিটিবিতে ‘বকশিশ বাণিজ্য’

পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ নেই। এতে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার বই ছাপার কাজে জামানত রাখা অর্থছাড়েও ‘বকশিশ বাণিজ্য’ করার অভিযোগ উঠেছে। শুধু ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৭০০ লট বইয়ের কাজ করা ছাপাখানা মালিকদের কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। ছাপাখানা মালিক ও মুদ্রণ শিল্প সমিতির সদস্যদের অভিযোগ, জামানতের টাকা ছাড় করাতে গড়িমসি করে এনসিটিবি। তারা প্রতি লট বইয়ের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দাবি করেন। টাকা না দিলে জামানতের অর্থছাড়ে গড়িমসি করেন। এতে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরীও জড়িত বলে অভিযোগ তাদের। জামানতের অর্থছাড়ে ‘বকশিশ’ নেওয়ার কথা স্বীকারও করেন দুজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তবে যে সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই রিয়াদ চৌধুরীর দাবি—তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রে নেমেছে। তারা এমন অভিযোগ করতে পারে বলে দাবি এনসিটিবির এ সদস্যের। আরও পড়ুন১৮ কোটি বই ছাপা বাকি, এবারও উৎসব ফিকে হওয়ার ‘শঙ্কা’জানুয়ারির শুরুতে স

বই ছাপার জামানতের অর্থছাড়েও এনসিটিবিতে ‘বকশিশ বাণিজ্য’

পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ নেই। এতে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার বই ছাপার কাজে জামানত রাখা অর্থছাড়েও ‘বকশিশ বাণিজ্য’ করার অভিযোগ উঠেছে। শুধু ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৭০০ লট বইয়ের কাজ করা ছাপাখানা মালিকদের কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

ছাপাখানা মালিক ও মুদ্রণ শিল্প সমিতির সদস্যদের অভিযোগ, জামানতের টাকা ছাড় করাতে গড়িমসি করে এনসিটিবি। তারা প্রতি লট বইয়ের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দাবি করেন। টাকা না দিলে জামানতের অর্থছাড়ে গড়িমসি করেন। এতে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরীও জড়িত বলে অভিযোগ তাদের।

জামানতের অর্থছাড়ে ‘বকশিশ’ নেওয়ার কথা স্বীকারও করেন দুজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তবে যে সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই রিয়াদ চৌধুরীর দাবি—তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রে নেমেছে। তারা এমন অভিযোগ করতে পারে বলে দাবি এনসিটিবির এ সদস্যের।

আরও পড়ুন
১৮ কোটি বই ছাপা বাকি, এবারও উৎসব ফিকে হওয়ার ‘শঙ্কা’
জানুয়ারির শুরুতে সব বই পাবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা
প্রাথমিকে লাগাতার কর্মবিরতি শুরু, বার্ষিক পরীক্ষা ঘিরে সংশয়

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি থেকে ক্রয়াদেশের অনুমোদনের পর দরপত্র জমা দেওয়া কোন ছাপাখানা কত বই ছাপার কাজ পেয়েছে, তা জানিয়ে চিঠি ইস্যু করে এনসিটিবি। তাতে চুক্তি করতে ১৪ দিনের মধ্যে পারফরম্যান্স গ্যারান্টি (পিজি) বা জামানত জমা দিতে বলা হয়। অর্থের পরিমাণ বিবেচনায় কোনো লটে ১০ শতাংশ, কোনো লটে ২০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টি জমা দিতে হয়। এরপর চুক্তি হয়। মূলত কেউ যদি কাজ শেষ না করে বা দরপত্রের নিয়ম না মেনে ত্রুটিপূর্ণ ও নিম্নমানের বই ছাপিয়ে সরবরাহ করে; তাকে জরিমানা করতে এ জামানত রাখা হয়। কাজ শেষে চুক্তির এক বছর পর এ টাকা ফেরত দেয় এনসিটিবি।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতা, সদস্য ও ছাপাখানা মালিকদের অভিযোগ, জামানতের টাকা ফেরত পেতে এনসিটিবিতে ধরনা দিতে হয় তাদের। এ অর্থছাড়ের মূল দায়িত্ব এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক রিয়াদ চৌধুরীর। পিএ হিসেবে তার সই ছাড়া অর্থ ছাড় হয় না। এ টাকা ছাড় করার সময় লটপ্রতি ২০ হাজার করে টাকা দাবি করা হয়। রিয়াদ চৌধুরীর অধীন এ কাজে যুক্ত কর্মকর্তারা এ দাবি করেন। তারা এনসিটিবি সদস্যের নির্দেশে এ টাকা দাবি করেন বলে ছাপাখানা মালিকদের জানান। অর্থছাড় করাতে ছাপাখানার মালিকরা বাধ্য হয়ে লটপ্রতি ২০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। গত বছর প্রায় সাড়ে ৮০০ লটের মধ্যে অন্তত ৭০০ লটের টাকা ছাড়ে এ অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ ছাপাখানা মালিকদের। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের অন্তত ১২ লটের বই ছাপা ও বিতরণের কাজ করা একটি ছাপাখানার মালিক নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রত্যেক লটের জন্য ২০ হাজার করে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি। জামানতের অর্থছাড় করাতে গেলে এ দাবি করে বসেন কর্মকর্তারা। এটা দেখভালের দায়িত্ব মেম্বার টেক্সট (সদস্য, পাঠ্যপুস্তক) রিয়াদ চৌধুরীর। আমি মনে করি, তার যোগসাজশ ছাড়া এভাবে টাকা চাওয়ার সাহস কোনো কর্মকর্তার হওয়ার কথা নয়।’

একই অভিযোগ করেন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক একজন নেতাও। তিনি নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুদ্রণ শিল্প সমিতির সদস্যরা যারা বই ছাপার কাজ করছেন, তাদের দেওয়া তথ্যমতে—২০২৫ সালের প্রায় ৭০০ লট বই ছাপার কাজ শেষে পারফরম্যান্স গ্যারান্টির (জামানত) অর্থছাড় করাতে দেড় কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা। যে বা যারাই টাকা নিক, স্বাভাবিকভাবেই পিএ (রিয়াদ চৌধুরী) এতে জড়িত। তিনি এখন এনসিটিবির সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তা।’

ছাপাখানা মালিকদের অভিযোগের পর এ নিয়ে জামানতের টাকা ছাড়ে যুক্ত এবং অবগত—এমন দুজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে ‘বকশিশ’ হিসেবে ‘কিছু’ টাকা নেন বলে স্বীকার করেন তারা। ওই দুজনের দাবি, ‘তারা যা (টাকা নেওয়া) করেন, তা সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) রিয়াদ চৌধুরী জানেন।’

আরও পড়ুন
পাঠ্যবইয়ে নিম্নমানের কাগজ আর নয়, বাধ্যতামূলক হচ্ছে জলছাপ
‘মাদরাসার শিক্ষার্থীদের কোয়ালিটি আছে, সেটা স্বীকার করা উচিত’
প্রাথমিকে ধর্ম শিক্ষকের বিষয়ে কী ভাবছে সরকার

জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জামানতের টাকাটা রাখা হয় পরবর্তী ঝঁকি বিবেচনায়। কেউ যদি ভালোভাবে কাজ শেষ করে; তাহলে তাকে জিম্মি করে এভাবে টাকা আদায় অবশ্যই অপরাধ। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যাচাই করে দেখা উচিত।’

দীর্ঘদিন মুদ্রণ ব্যবসায়ে জড়িত ও মুদ্রণ শিল্প সমিতির জ্যেষ্ঠ আরেকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এনসিটিবিতে নিয়মিত চেয়ারম্যান না থাকায় কেউ কেউ মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে অনিয়ম করছেন। তাদের মধ্যে একজন রিয়াদ চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগ আমলেও সুবিধাভোগী ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বছর যে সাড়ে ৬০০ লট বই ছাপা হচ্ছে, তা থেকেও টাকা নেওয়ার ফন্দি আঁটছেন বলে জেনেছি। এজন্য এনসিটিবিতে নিয়মিত চেয়ারম্যান ও বর্তমান দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তবে এমন অভিযোগের কথা কখনই শোনেননি বলে দাবি করেছেন এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক রিয়াদ চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘জামানতের টাকা ছাড় করতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি থেকে ওটিপি পাঠানো হয়। সেটা আমার অফিসিয়াল নম্বরে আসে। একদিনে ২০টির বেশি ওটিপি এক নম্বরে পাঠানো যায় না। এজন্য প্রথম দিকে টাকা ছাড় করাতে একটু দেরি হয়েছে। এতে অনেকে সন্দেহ পোষণ করতে পারেন। কিন্তু অনিয়ম বা কারও কাছ থেকে টাকা চাওয়া বা নেওয়া হয়েছে, এমন কথা শুনিনি। আমার অধীন কেউ যদি এটা করে; কে করেছে; তা জানতে পারলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বর্তমানে এনসিটিবিতে নিয়মিত কোনো চেয়ারম্যান নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুল হক পাটওয়ারীকে চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ অভিযোগটা মনে হয় আগের। সম্প্রতি আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কেউ আমাকে এ বিষয়ে অবগত করেনি। বিষয়টি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখবো। যদি প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়, তদন্ত করা হবে। কেউ অনিয়ম করলে অবশ্যই সরকার ব্যবস্থা নেবে।’

এএএইচ/ইএ

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow