৩ লাখ গ্র্যাজুয়েটের মধ্যেও মেলেনি যোগ্য প্রার্থী, ৫০২ পদ ফাঁকা
# শেষ ছয়টি বিসিএসে ৮৬৩ পদ ফাঁকা, শুধু ৪৫-এ ৫০২ # পিএসসি বলছে—শর্ত পূরণ না করলে নিয়োগ সুপারিশ নয় # অদূরদর্শিতা-ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিকে দায়ী করছেন চাকরিপ্রার্থীরা # পদ ফাঁকা রাখা অন্যায্য, পিএসসিকে পথ খোঁজার পরামর্শ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দীর্ঘ তিন বছর পর ৪৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। বিজ্ঞপ্তিতে দুই হাজার ৩০৯টি পদ থাকলেও নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছেন এক হাজার ৮০৭ জন। অর্থাৎ, বিজ্ঞাপিত পদের মধ্যে ৫০২টি ক্যাডার পদই ফাঁকা রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন—এতসংখ্যক ক্যাডার পদ ফাঁকা রাখা ‘নজিরবিহীন’ ও ‘অন্যায্য’। পিএসসি জানিয়েছে, বিভিন্ন পেশাগত বা কারিগরি ক্যাডার পদে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় এসব পদ ফাঁকা রাখা হয়েছে। সেখানে মনোনয়ন দেওয়ার মতো উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায়নি। পরবর্তী বিসিএসে এসব পদে পুনরায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এদিকে, এতসংখ্যক শূন্যপদ ফাঁকা রেখে চূড়ান্ত সুপারিশ করায় পিএসসির প্রতি ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ—প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় কম প্রার্থীকে উত্তীর্ণ করায় শেষদিকে আর যোগ্য প্রার্থী পাচ্ছে না পিএসসি।
# শেষ ছয়টি বিসিএসে ৮৬৩ পদ ফাঁকা, শুধু ৪৫-এ ৫০২
# পিএসসি বলছে—শর্ত পূরণ না করলে নিয়োগ সুপারিশ নয়
# অদূরদর্শিতা-ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিকে দায়ী করছেন চাকরিপ্রার্থীরা
# পদ ফাঁকা রাখা অন্যায্য, পিএসসিকে পথ খোঁজার পরামর্শ
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দীর্ঘ তিন বছর পর ৪৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। বিজ্ঞপ্তিতে দুই হাজার ৩০৯টি পদ থাকলেও নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছেন এক হাজার ৮০৭ জন। অর্থাৎ, বিজ্ঞাপিত পদের মধ্যে ৫০২টি ক্যাডার পদই ফাঁকা রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন—এতসংখ্যক ক্যাডার পদ ফাঁকা রাখা ‘নজিরবিহীন’ ও ‘অন্যায্য’।
পিএসসি জানিয়েছে, বিভিন্ন পেশাগত বা কারিগরি ক্যাডার পদে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় এসব পদ ফাঁকা রাখা হয়েছে। সেখানে মনোনয়ন দেওয়ার মতো উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায়নি। পরবর্তী বিসিএসে এসব পদে পুনরায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
এদিকে, এতসংখ্যক শূন্যপদ ফাঁকা রেখে চূড়ান্ত সুপারিশ করায় পিএসসির প্রতি ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ—প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় কম প্রার্থীকে উত্তীর্ণ করায় শেষদিকে আর যোগ্য প্রার্থী পাচ্ছে না পিএসসি। অথচ তিন বছর ধরে একটি বিসিএসের জন্য অপেক্ষা করেন লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার। ‘যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায়’ ক্যাডার পদ ফাঁকা রাখাকে পিএসসির ‘অদূরদর্শিতা’ দায়ী বলে অভিযোগ তাদের।
জানা যায়, ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এতে দুই হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়ার কথা ছিল। এ বিসিএসে অংশ নিতে আবেদন করেন তিন লাখ ৪৬ হাজারের কিছু বেশি পরীক্ষার্থী। ২০২৩ সালের ১৯ মে প্রিলিমিনারি টেস্ট নেওয়া হয়। প্রিলিতে অংশ নেন দুই লাখ ৬৮ হাজার ১১৯ জন। প্রাথমিক এ বাছাইয়ে উত্তীর্ণ করা হয় ১২ হাজার ৭৮৯ জন প্রার্থীকে।
২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়, যা শেষ হয় ৩১ জানুয়ারি। প্রায় ১৬ মাস পর ১৮ জুন ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এতে মাত্র ৬ হাজার ৫৫৮ জনকে পাস করানো হয়। তাদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয় ৮ জুলাই থেকে। কয়েক ধাপে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে অবশেষে ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। এ বিসিএস শেষ করতে পিএসসির সময় লেগেছে তিন বছর। দীর্ঘ সময় নিয়ে একটি বিসিএস শেষ করলেও তাতে ৫০২টি ক্যাডার পদ ফাঁকা রাখা হয়েছে, যা নিয়ে হতাশ চাকরিপ্রার্থীরা।
শেষ পাঁচটিতে পদ ফাঁকার শীর্ষে ৪৫তম বিসিএস
যোগ্য প্রার্থী না থাকায় পেশাগত/কারিগরি ক্যাডারে প্রত্যেকটি বিসিএসে স্বল্পসংখ্যক পদ থেকে যায়। তবে ৪৫তম বিসিএসে তা বহুগুণ বেশি। ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩ ও ৪৪ বিসিএস মিলিয়ে মোট ৩৬১টি পদ ফাঁকা রাখা হয়েছি। অথচ শুধু ৪৫তম বিসিএসে ৫০২ পদ ফাঁকা থাকলো। এক বিসিএসে এতসংখ্যক পদ ফাঁকা থাকা নজিরবিহীন বলে মনে করছেন খোদ পিএসসির কর্মকর্তারা।
পিএসসি সূত্র জানায়, ৪০তম বিসিএসে ২ হাজার ২১৯টি শূন্যপদের বিপরীতে ১ হাজার ৯৬৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এতে পদ ফাঁকা ছিল ২৫৬টি। ৪১তম বিসিএসে ২ হাজার ৫৩৬টি পদের বিপরীতে নিয়োগের সুপারিশ পান ২৫২০ জন। ফলে এ বিসিএসে ফাঁকা থেকে যায় ১৬টি ক্যাডার পদ।
৪২তম বিসিএস ছিল চিকিৎসক নিয়োগে বিশেষ বিসিএস। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে এ বিসিএসে বিজ্ঞাপিত পদের চেয়েও বেশি চিকিৎসা ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
৪৩তম বিসিএসে ২ হাজার ২১৮টি ক্যাডার পদের বিপরীতে নিয়োগের সুপারিশ পান ২ হাজার ১৬৩টি। এ বিসিএসে ফাঁকা ছিল ৫৫টি ক্যাডার পদ। ৪৪তম বিসিএসে ক্যাডার পদ ফাঁকা ছিল ৩৪টি। বিজ্ঞপ্তিতে শূন্যপদ ছিল ১ হাজার ৭১০টি। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফলে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পেয়েছেন ১ হাজার ৬৭৬ জন।
সবশেষ ৪৫তম বিসিএসে বিজ্ঞপ্তিতে থাকা পদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পদই ফাঁকা রাখা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে পদ ছিল ২ হাজার ৩০৯টি। আর নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছেন ১ হাজার ৮০৭ জন। ফলে ৫০২টি ক্যাডার পদ ফাঁকা।
পিএসসির ‘অদূরদর্শিতা’কে দায়ী করছেন চাকরিপ্রার্থীরা
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, পিএসসি আগে একটি শূন্যপদের বিপরীতে ১০ জনকে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতো। ফলে আগে ক্যাডার পদ শূন্য থাকার সংখ্যাও কম ছিল। ধীরে ধীরে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা কমানো হচ্ছে। ফলে মৌখিকে যোগ্য প্রার্থী মিলছে না।
তাদের দাবি—একটি শূন্যপদের বিপরীতে ২০ জনকে প্রিলিতে পাস করাতে হবে। আর প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষায় অন্তত ১০ জনকে রাখতে হবে। তাহলে এ সংকট তৈরি হবে না।
টানা দুটি বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা আমজাদ হোসেন। বুধবার রাতে তিনি জাগো নিউজক বলেন, ‘পিএসসি দ্রুত পরীক্ষা আয়োজন ও খাতা মূল্যায়ন শেষ করার জন্য প্রিলিতে কাট মার্কস (পাস বিবেচনা করতে নির্ধারিত নম্বর) নির্ধারণ করছে বেশি। ফলে দুই হাজার পদের জন্য মাত্র ১০ হাজার প্রার্থীকে প্রিলি উত্তীর্ণ ঘোষণা করছে। অর্থাৎ, প্রিলিতে টেকানো হচ্ছে একটি শূন্যপদের বিপরীতে মাত্র ৫ জনকে।’
তিনি বলেন, ‘এরপর লিখিত পরীক্ষায় পাস করানো হচ্ছে প্রতি পদের বিপরীতে দুই থেকে তিনজনকে। ফলে মৌখিকে গিয়ে কোনো পেশাগত ক্যাডারের কোনো প্রার্থী খারাপ করলে ওই পদটিই শূন্য থেকে যাচ্ছে। এটা পিএসসির অদূরদর্শিতা অথবা তাদের অবহেলা। চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি ও কষ্টকে তারা উপেক্ষা করছেন; যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেও একই বক্তব্য পাওয়া গেছে। তারা সবাই একাধিকার বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছেন।
চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে হিসাবে। ৪৫তম বিসিএসে ২৩০৯টি পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন দুই লাখ ৬৮ হাজার ১১৯ জন। তাদের মধ্য থেকে প্রিলিতে পাস করানো হয় ১২ হাজার ৭৮৯ জনকে। হিসাব অনুযায়ী—প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে পিএসসি পাস করিয়েছে মাত্র ৫ জনকে।
লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন প্রিলিতে উত্তীর্ণরা। সেখানে দেখা যায় লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন মাত্র ৬৫৫৮ জন। ফলে শূন্যপদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮৪ জন (প্রায় তিনজন)। অর্থাৎ মৌখিক পরীক্ষায় প্রতিটি পদের বিপরীতে অংশ নিয়েছে প্রায় তিনজন।
কী বলছে পিএসসি, ফাঁকা পদ পূরণ কীভাবে
প্রত্যেকটি বিসিএসে কিছু পদ ফাঁকা থাকে। এবার নজিরবিহীনভাবে ৫০২টি পদ ফাঁকা রাখার কারণ জানতে চাইলে পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এস এম মতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মূলত কারিগরি/পেশাগত ক্যাডারগুলো বেশি ফাঁকা। শুধুমাত্র পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে ৪৪০টি পদ ফাঁকা থেকে গেছে। সেখানে মাত্র এক বা দুজন যোগ্য প্রার্থী পাওয়া গেছে। বরাবরই কারিগরি/পেশাগত ক্যাডারে কিছু পদ শূন্য থাকে। এবার হয়তো সেটা কিছুটা বেশি।’
নাম প্রকাশ না করে পিএসসির একজন সদস্য বুধবার রাতে জাগো নিউজকে বলেন, পিএসসি সব সময় যোগ্য প্রার্থীকে সুপারিশ করতে চায়। নিয়োগ শর্ত পূরণ না হলে তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডারে নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের শর্ত মনতে হয়। এতে অনেক সময় সব পদ পূরণ করা সম্ভব হয় না। সামনে কীভাবে আরও বেশিসংখ্যক পদে নিয়োগ নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে কমিশন।
পিএসসির কর্মকর্তারা জানান, ফাঁকা থেকে যাওয়া পদগুলোতে পরবর্তী বিসিএস থেকে যোগ্য প্রার্থী নেওয়া হয়। যেসব পদ ফাঁকা থেকে যায়, তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়। সেগুলো পরবর্তী বিসিএসে সমন্বয় করে মন্ত্রণালয়। যখন জনপ্রশাসন থেকে পিএসসিতে জনবলের চাহিদা পাঠানো হয়, তাতে আগের ফাঁকা পদগুলো যুক্ত করে দেওয়া হয়।’
এত পদ ফাঁকা রাখা ‘অন্যায্য-অমানবিক’
পিএসসি যেভাবেই ব্যাখ্যা দিক না কেন, পদ ফাঁকা রাখাটা ‘অন্যায্য’ ও ‘অমানবিক’ বলে মনে করেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থী আবেদন করলো, আড়াই-তিন লাখ পরীক্ষা দিলো। অথচ আপনি ২৩০৯টি পদ পূরণ করতে পারলেন না! তাদের মধ্যে যোগ্য কাউকে পেলেন না! তিন বছর তাদের আটকে রাখলেন এক চাকরির পরীক্ষায়। অথচ পদও ফাঁকা রাখলেন, তাদেরকেও বেকার করেই রাখলেন; এমন পাবলিক সার্ভিস কমিশন তো আমাদের কাম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পিএসসিকে অবশ্যই এ পদ ফাঁকা রাখার পথ পরিহার করতে হবে। কীভাবে সেটা করা যায়, তা জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে। নিশ্চয়ই পথ বের হবে বলে আমি মনে করি।’
এএএইচ/এমআরএম
What's Your Reaction?