৬০ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: অর্জন, সংকট এবং প্রত্যাশা
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিদ্যাপীঠ ৫৯ বছর পেরিয়ে ৬০ বছরের পদার্পণ করেছে। পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠটি ৫৯ বছর ধরে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। দীর্ঘ পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির রয়েছে অসংখ্য অর্জন, নানান সংকট ও সম্ভাবনা। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীর জোবরা গ্রামে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের কাছে শাটল ট্রেন নিত্যদিনের সঙ্গী। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাটল ট্রেনেও বেড়েছে ভিড়। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন সংকট। স্বপ্নের শাটল ট্রেনে ঘুরতে এসে অনেকেই এখন দিবালোকেই দেখেন শাটলের অব্যবস্থাপনার দুঃস্বপ্ন। অবশ্য সম্প্রতি নতুন দুটি ট্রেন যুক্ত করেছে চবি কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাবাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি এ চার বিভাগ নিয়ে সাতজন শিক্ষক ও দুইশ শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন অধ্যা
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিদ্যাপীঠ ৫৯ বছর পেরিয়ে ৬০ বছরের পদার্পণ করেছে। পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠটি ৫৯ বছর ধরে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। দীর্ঘ পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির রয়েছে অসংখ্য অর্জন, নানান সংকট ও সম্ভাবনা।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীর জোবরা গ্রামে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের কাছে শাটল ট্রেন নিত্যদিনের সঙ্গী। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাটল ট্রেনেও বেড়েছে ভিড়। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন সংকট। স্বপ্নের শাটল ট্রেনে ঘুরতে এসে অনেকেই এখন দিবালোকেই দেখেন শাটলের অব্যবস্থাপনার দুঃস্বপ্ন। অবশ্য সম্প্রতি নতুন দুটি ট্রেন যুক্ত করেছে চবি কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা
বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি এ চার বিভাগ নিয়ে সাতজন শিক্ষক ও দুইশ শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. আজিজুল রহমান মল্লিক। বর্তমানে ৯টি অনুষদে ৪৮টি বিভাগ, ৬টি ইনস্টিটিউট, ৯২০ জন শিক্ষক ও প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আছে ১৪টি আবাসিক হল ও একটি ছাত্রাবাস। এর মধ্যে ৯টি ছেলেদের ও ৫টি মেয়েদের।
গুণীজন
দেশের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠ জন্ম দিয়েছে অনেক গুণীজনের। বরেণ্য মনীষীদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে এ ক্যাম্পাস। উপ-মহাদেশের খ্যাতিমান ভৌতবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবুল ফজল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মান্নানসহ বহু কীর্তিমান মনীষী জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শাটলের ক্যাম্পাস
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম শাটল ট্রেন। ১৯৮০ সালে যাতায়াতের সুবিধার্থে চবিতে প্রথম শাটল ট্রেন চালু হয়। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীদের বয়ে আনা এ শাটল যেন কালের সাক্ষী ও ঐতিহ্যের ধারক। দিনের পর দিন বগি চাপড়ে গানে গানে শাটল মাতিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার পথে পুরোটা সময় গানে গানে মুখর থাকে শাটলের সবকটি বগি।
সমাবর্তন
৫৯ বছরের ইতিহাসে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র ৫টি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৮ বছর পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম দায়িত্ব থাকাকালীন ১৯৯৪ সালে প্রথম সমাবর্তন হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়, ২০০৮ সালে তৃতীয় এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ সমাবর্তন। ২০২৫ সালের বুধবার (১৪ মে) পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে এটি দেশের অন্যতম বৃহৎ সমাবর্তনে রূপ নেয়। পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লিটারেচার (ডি.লিট.)’ ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
এছাড়া সমাবর্তনে ৪২ জনকে পিএইচডি, ৩৩ জনকে এমফিলসহ মোট ২২ হাজার ৫৮৬ শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি দেয়া হয়।
সমৃদ্ধ লাইব্রেরি
৫৬ হাজার ৭০০ বর্গফুট পরিমিত এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এটি চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক গ্রন্থাগার। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর মাত্র ৩০০ বই নিয়ে যে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়। লাইব্রেরির ‘দুষ্প্রাপ্য ও পাণ্ডুলিপি’ শাখায় রয়েছে পরাগল খাঁর ‘মহাভারত’ থেকে শুরু করে আবুল ফজলের আকবরনামা পর্যন্ত।
এমফিল ও পিএইচডি গবেষকদের জন্য রয়েছে ২৪টি গবেষণাকক্ষ। এখানে ১৯৬৮ সাল থেকে প্রকাশিত আঞ্চলিক ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকা বাঁধাই করে সংরক্ষণ করা আছে। ১৮৭২ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় চার হাজার পুরোনো সাময়িকই রয়েছে শাখাটিতে।
এই গ্রন্থাগারে বর্তমান সংগ্রহে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ বই রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বিরল বই, জার্নাল, অডিও-ভিজ্যুয়াল উপাদান, পাণ্ডুলিপি ও দৃষ্টিহীনদের ব্রেইল বই। শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা লাইব্রেরিতে বই নিয়ে প্রবেশ নিষেধ কর্তৃপক্ষের।
আন্দোলন সংগ্রামে চবি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ১২ জন শিক্ষার্থী এবং তিনজন কর্মকর্তা শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। এই ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে, মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে জিরো পয়েন্ট চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ, যা স্মরণ চত্বর নামে পরিচিত। সর্বশেষ ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অভ্যুত্থানে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী হৃদয় তরুয়া ও ফরহাদ হোসেন।
চাকসু
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে মাত্র সাতবার। এর মধ্যে প্রথম নির্বাচনটি হয় ১৯৭০ সালে। আর সর্বশেষ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৫ অক্টোবর ২০২৫ সালে। ১৯৭৩ সালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
১৯৭০ সালের প্রথম চাকসু নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং জিএস হন ছাত্রলীগের আবদুর রব। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন চাকসু জিএস আবদুর রব। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় চাকসু নির্বাচন। এ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা ভিপি এবং জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের তৃতীয় চাকসু নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের এস এম ফজলুল হক ভিপি ও গোলাম জিলানী চৌধুরী জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের চতুর্থ চাকসু নির্বাচনে ভিপি হন জাসদ ছাত্রলীগের মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী এবং জিএস হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের জমির চৌধুরী। ১৯৮১ সালে চাকসুর পঞ্চম নির্বাচনে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সে সময়ের নেতা জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার। ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ চাকসু নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রার্থী জাতীয় ছাত্রলীগের নাজিম উদ্দিন ভিপি নির্বাচিত হন। আর জিএস নির্বাচিত হন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ। ২০২৫ সালের ১৫ অক্টোবর ৪৪ বছর পর চাকসুতে আবারও নেতৃত্বে ফিরেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’-এর প্রার্থীরা ভিপি-জিএসসহ ২৪টি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এতে ভিপি (সহসভাপতি) পদে ছাত্রশিবিরের মো. ইব্রাহিম হোসেন রনি এবং জিএস (সাধারণ সম্পাদক) একই প্যানেলের সাঈদ বিন হাবিব নির্বাচিত হয়েছেন।
সংকট
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে নানামুখী সংকটের মুখে রয়েছে। শাটল ট্রেনের অদক্ষ পরিচালনা ও নিয়মিত ভোগান্তি তাদের প্রতিদিনের যাত্রাকে কষ্টকর করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী সেশনজট, যা শিক্ষাজীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। প্রশাসনিক ভবনে কাজের অকারণ জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা শিক্ষার্থীদের মৌলিক সেবা গ্রহণেও বাধা সৃষ্টি করে। হলের নিম্নমানের খাবার এবং সীমিত আবাসন সুবিধা ছাত্রজীবনের মানকে আরও নিচে নামিয়ে দেয়। পাশাপাশি লাইব্রেরির সীমাবদ্ধতা ও ক্যাম্পাসের অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ও দৈনন্দিন চলাচলে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাবেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি দীর্ঘমেয়াদি সংকটে রূপ নিয়েছে।
প্রত্যাশা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আশা করে শাটল ট্রেনের ভোগান্তি দূর করে আধুনিক ও কার্যকর সেবা নিশ্চিত করা হবে। সেশনজট দূর করে পড়াশোনার সময়সূচি স্বাভাবিক করা হবে। প্রশাসনিক ভবনের দীর্ঘসূত্রতা কমে দ্রুত সেবা পাওয়া যাবে। হলে খাবারের মান ও আবাসনের সুযোগ উন্নত হবে। লাইব্রেরি ও পরিবহন ব্যবস্থাও আধুনিক ও শিক্ষার্থী-বান্ধব হবে। সার্বিকভাবে তারা এমন একটি জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর প্রশাসন চায়, যা বাস্তব পরিবর্তন এনে শিক্ষাজীবনকে সহজ করবে।
সোহেল রানা/এমআরএম
What's Your Reaction?