গাজীপুরে একের পর এক খুন, মরদেহ উদ্ধার, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনায় আতঙ্কে ভুগছে নগরবাসী। বিশেষ করে চান্দনা চৌরাস্তায় শত শত লোকের সামনে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার পর ওই এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে গাজীপুরকে অনিরাপদ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।
তবে পুলিশের দাবি, এখনো পুরোপুরি সক্রিয় না পুলিশ। এছাড়া বিশাল আয়তনের এই সিটি করপোরেশনের নিরাপত্তায় পুলিশের জনবলও অপ্রতুল। মাত্র ১১০০ পুলিশ সদস্য দিয়ে কাজ চলছে পুরো সিটি করপোরেশনের। তারপরও নগরবাসীর নিরাপত্তায় কাজ করছে তারা।
‘এরশাদ নগর থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত চার কিলোমিটার এলাকাটি ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই মোবাইল ছিনতাই, টাকা ছিনতাই হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। ছিনতাই হচ্ছে দেখেও ভয়ে কেউ এগিয়ে যায় না।’
সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, গাজীপুর সিটির আয়তন ৩২৯ দশমিক ৫৩ বর্গকিলোমিটার। যা আয়তনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন। ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা প্রায় ৬৫ লাখ। সেই হিসাব মতে এখানে প্রতি ৫ হাজার ৯০৯ জনের নিরাপত্তায় কাজ করছেন একজন পুলিশ সদস্য।
গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা, টঙ্গী ও কোনাবাড়ি এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে একজন সাংবাদিককে খুন করার পর পুলিশ দ্রুততম সময়ে খুনিদের গ্রেফতার করে প্রশংসা অর্জন করে। কিন্তু গ্রেফতার আসামিরা পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়েছেন। এছাড়া আসামিদের আদালতে নেওয়া হলে প্রিজনভ্যানের ভেতর থেকে কয়েকজন আসামি তাদের অপর সহযোগীদের নাম প্রকাশ করেন। যারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এ ঘটনায় জেলার অন্য সাংবাদিকরাও আতঙ্কিত।
- আরও পড়ুন
- টঙ্গীতে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গণপিটুনিতে যুবক নিহত
- গাজীপুরে হাত-পা বাঁধা যুবককে খাদে ফেলে পালারো দুর্বৃত্তরা
- টঙ্গীতে ব্যাগে মিললো যুবকের ৮ টুকরো মরদেহ, রহস্য উন্মোচন
চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ২৫ বছর ধরে চৌরাস্তায় ব্যবসা করছি। ছিনতাই, চুরি, পকেটমার, মারামারি প্রায় সময়ই হয়, কিন্তু শত শত মানুষের সামনে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা এটিই প্রথম। এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আগেভাগে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে চলে যাই।
‘চৌরাস্তা এলাকায় একটি বেসরকারি স্কুলে আমার ছেলে লেখাপড়া করে। স্ত্রী একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। এখন আমি তাদের নিয়েও শঙ্কায় আছি।’
শরীফ হোসেন নামে এক চাকরিজীবী বলেন, চৌরাস্তা এলাকায় একটি বেসরকারি স্কুলে আমার ছেলে লেখাপড়া করে। স্ত্রী একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। এখন আমি তাদের নিয়েও শঙ্কায় আছি।
এদিকে সাংবাদিক তুহিন হত্যার আগের দিন জেলা শহরের সাহাপাড়া এলাকায় আনোয়ার হোসেন নামে এক সাংবাদিককে মারধর করে এবং ইট দিয়ে তার হাত-পা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেতলে দেয় দুর্বৃত্তরা। মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
‘গাজীপুরে স্থানীয় লোকদের চাইতে বাইরের লোক বেশি। শিল্পাঞ্চল হওয়ায় মানুষের অনেক ঘনবসতি। আর যারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তারা সবাই অন্য জেলার মানুষ। অনেকে নিজ জেলায় অপরাধ করে গাজীপুরে আশ্রয় নেয়। ’
এছাড়া টঙ্গীতে গত ৬ আগস্ট রাতে অলি নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার পর মরদেহ ৮ টুকরো করে ট্রাভেল ব্যাগে করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। এ ঘটনায় জড়িতদের র্যাব গ্রেফতার করেছে। একইদিন গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকায় এক ডেকোরেটর ব্যবসায়ীর মরদেহ উদ্ধার করে জয়দেবপুর থানা পুলিশ। একইদিন মহানগরীর কোনাবাড়ি এলাকা থেকে এক অটোরিকশা চালকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিনই কাশিমপুর এলাকায় স্ত্রীকে হত্যা করে পুলিশে ফোন দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন স্বামী।
- আরও পড়ুন
- সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা: সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা গেলো
- বাদশাকে কোপানোর ভিডিও ডিলিট না করায় সাংবাদিক তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা
- গাজীপুরে প্রকাশ্যে সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা
এদিকে শনিবার (৯ আগস্ট) দিবাগত রাতে মহানগরীর বোর্ডবাজারে কলমেশ্বর এলাকায় হাফিজুর রহমান নামে গাজীপুরের সাবেক এক সিভিল সার্জনের বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। বাড়ির কেয়ারটেকার ও গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীকে বেঁধে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় গাজীপুরের সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকার ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন বলেন, গাজীপুরে বিআরটি প্রকল্প হওয়ার পর উড়াল সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল করে বেশি। এরশাদ নগর থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত চার কিলোমিটার এলাকাটি ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই মোবাইল ছিনতাই, টাকা ছিনতাই হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। ছিনতাই হচ্ছে দেখেও ভয়ে কেউ এগিয়ে যায় না।
তিনি আরও বলেন, উড়াল সড়কের নিচের অবস্থা আরও ভয়াবহ। মাদকসেবী, বিক্রেতা, ভবঘুরে এবং নানা অপরাধীদের আস্তানা হচ্ছে উড়াল সড়কের নিচে থাকা বিআরটি প্রকল্পের ঘরসমূহ। সন্ধ্যার পর এমনকি দিনের বেলাতেও উড়াল সড়কের নিচ দিয়েও মানুষ চলাচল করতে ভয় পায়। টঙ্গী এলাকা মাদকে সয়লাব থাকায় এখানে অপরাধের মাত্রাও বেশি।
গাজীপুরের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, গাজীপুরে স্থানীয় লোকদের চাইতে বাইরের লোক বেশি। শিল্পাঞ্চল হওয়ায় মানুষের অনেক ঘনবসতি। আর যারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তারা সবাই অন্য জেলার মানুষ। অনেকে নিজ জেলায় অপরাধ করে গাজীপুরে আশ্রয় নেয়। আর সুযোগ বুঝে তারা এখানে নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। অপরাধ করতে দেখলেও অনেকে অপরাধীদের চিনতে পারেন না।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, ঢাকার চাইতে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুর। আগে একজন পুলিশ যে সাহসিকতা দেখাতো এখন তিনজন পুলিশও সে সাহসিকতা দেখাতে পারছে না। এখনো পুলিশ ভীতসন্ত্রস্ত। কাশিমপুর থানায় প্রতি ১৪০০ মানুষের জন্য একজন পুলিশ কাজ করে। এছাড়া ১১০০ পুলিশ দিয়ে বিশাল আয়তনের বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কাজ করা কষ্টসাধ্য। তারপরও মানুষের সহযোগিতায় পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। গাজীপুরের মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের প্রধান কাজ। আমরা চেষ্টা করছি মানুষের নিরাপত্তা দিতে।
এফএ/জিকেএস