‘আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিপক্ষ দমনের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, গণজাগরণ মঞ্চের নামে শাহবাগে মব কালচারের সৃষ্টি করা হয়। সেখানে বিচারের দাবির পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকারের সহযোগীতায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়।’
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
মামলার ৪৬তম সাক্ষী হিসেবে সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এসব তথ্য জানান মাহমুদুর রহমান।
জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমান বলেন, সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করার পর ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের দিকে মনোনিবেশ করে। এই লক্ষ্যে তারা সর্বপ্রথম ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণজাগরণ মঞ্চের নামে শাহবাগে মব কালচারের সৃষ্টি করা হয়। সেখানে বিচারের দাবির পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকারের সহযোগীতায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়।
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক আরও বলেন, ২০১৩ সালে শাহবাগে একটি বিশেষ রাজনৈতিক শ্রেণিকে নির্মূল করার পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য সরকার দিনের পর দিন বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই সময় শাহবাগের কিছু বিক্ষোভকারীর নির্দেশে সরকার পরিচালিত হতে থাকে। তাদের নির্দেশে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা রাস্তায় দাড়িয়ে ফাঁসির দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। স্বয়ং শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন যে, এরা সবাই দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি (শখ হাসিনা) মানসিকভাবে সারাক্ষণ শাহবাগেই থাকেন।
মাহমুদুর রহমান বলেন, এমনকি ভারতীয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন যে, প্রটোকলে না আটকালে তিনি নিজেও শাহবাগে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করতেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, শাহবাগের এই তথাকথিত আন্দোলনে ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিলো। শাহবাগের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রের আইন পরিবর্তন করে রেট্রোসপেক্টিভ ইফেক্ট দিয়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাকে আপিল বিভাগে ফাঁসির রায়ে পরিবর্তন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি চরম অবিচারের উদাহরণ হয়ে থাকবে।
মাহমুদুর রহমান বলেন, ফাঁসির দাবি করার বাইরেও গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তারা দেশের যেসব মিডিয়া এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বিবেচনায় ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের মালিকানাধীন সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানায়।
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, শাহবাগের উদ্যোক্তাদের ইসলাম বিদ্বেষী চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়লে এর প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে মধ্য রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালানো হয়। সেই গণহত্যায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার বেনজীর আহম্মেদ, র্যাবের অপারেশন চিফ কর্নেল জিয়াউল আহসান এবং বিজিবির তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহম্মেদ। গণহত্যার পুরস্কার হিসেবে বেনজীর আহমেদকে আইজিপি, জিয়াউল আহসানকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় এবং আজিজ আহম্মেদকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনা প্রধান করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পিছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদ সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দীক মূল ভূমিকা পালন করেছেন। বিচার বিভাগের মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তি যুগিয়েছে।
আইনজীবীদের কথা বলতে গিয়ে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল (প্রয়াত) মাহবুবে আলম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব (প্রয়াত) দুলাল, প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন, সাবেক চিফ প্রসিকিউর (প্রয়াত) গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর (প্রয়াত) জিয়াদ আল মালুম, দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এবং মোশাররফ হোসেন কাজল ফ্যাসিবাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে।
পুলিশ বাহিনীর কথা বলতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, বেনজীর আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, জাবেদ পাটোয়ারী, নুর মোহাম্মদ এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারুনুর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছেন।
নির্বাচন কমিশনের প্রসঙ্গে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ব্যতীত অন্যান্য কমিশনার এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সদস্যরা বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধবংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ (প্রয়াত), রওশন এরশাদ, জিএম কাদের ফ্যাসিবাদের সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে।
এছাড়া ১৪ দলীয় নেতাদের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দিলীপ বড়ুয়া, নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারী (প্রয়াত), ফজলে হোসেন বাদশা, শিরিন আক্তার এবং তাদের সঙ্গীরাও ফ্যাসিবাদ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ১৪ দলের বাইরে মেজর জেনারেল (অব.) ইব্রাহিম, শমশের মুবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মিজবাউর রহমান চৌধুরী, কাদের সিদ্দীকি, মাহি বি চৌধুরী প্রমুখ ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করেছেন বলে জানান মাহমুদুর।
সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পিছনে ২০০৮ সালে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ, জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন কর্মকর্তা জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী এবং ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ ভূমিকা রেখেছেন। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এ নির্বাচনকালীন সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না।
মাহমুদুর রহমান জবানবন্দিতে আরও বলেন, ডিজিএফআইয়ের অধিকাংশ মহাপরচিালক (ডিজি) এই সময়ের মধ্যে সরকারের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এদের মধ্যে মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মো. আকবর হোসেন, জেনারেল সাইফুল আমিন, তাবরেজ শামস এবং হামিদুল হক গুম ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। র্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এবং জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছেন।
এফএইচ/এমএমকে/জিকেএস