অনুকূল পরিবেশ হারাচ্ছে প্রজাপতি
স্রষ্টার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির সমাহার এ পৃথিবীকে রঙিন ও প্রাণবন্ত করে রেখেছে। এসব সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি রংবাহারি প্রজাপতি। রঙিন ডানার সৌন্দর্যের জন্য প্রজাপতি জগৎজুড়ে সমাদৃত। তাদের কোমল ডানার বর্ণচ্ছটা মুগ্ধ করে সব বয়সী মানুষকে।
তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের প্রতীক প্রজাপতির সৌন্দর্যে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে বলেছিলেন, প্রজাপতি! প্রজাপতি!/ কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা,/ টুকটুকে লাল-নীল ঝিলিমিলি আঁকা-বাঁকা।
প্রজাতির রঙিন ডানা, স্পন্দনশীল উপস্থিতি এবং রংবাহারি সৌন্দর্য প্রকৃতিতে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে। তাই প্রজাপতিকে প্রকৃতির অলংকারও বলা হয়। প্রজাপতি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না; বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং উদ্ভিদ ও ফসলের পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, গাছপালা নিধন, বন উজাড়, পানি দূষণ ও পরিবেশ ধ্বংসের ব্যাপকতায় কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার প্রকৃতি থেকে রঙিন ডানার চোখজুড়ানো প্রজাপতিরা বসবাসের অনুকূল পরিবেশ হারাচ্ছে। যার ফলে এরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। এতে প্রজাপতির প্রজাতি অনেক কমে যাচ্ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়ছে, বিঘ্নিত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশে।
জানা গেছে, প্রজাপতি লেপিডোপ্টেরা বর্গের অন্তর্গত এক ধরনের কীট। এদের শরীর উজ্জ্বল বর্ণের, দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। প্রজাপতি প্রজাপতি হয়েই জন্মায় না। প্রজাপতির জীবনের দুটো অধ্যায়। প্রথমে ডিম থেকে জন্ম নেয় শুঁয়োপোকা, তারপর একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর এরা প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয়। প্রজাপতি কারুকার্যখচিত জানার জন্য সহজেই নজর কাড়ে।
বিশ্বে প্রজাপতির আঠারো হাজারেরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে ১ হাজার ৫০০ প্রজাতি রয়েছে। প্রতিটি প্রজাপতির আলাদা আলাদা বৈজ্ঞানিক নাম রয়েছে। তবে বাংলাদেশে ৪২০ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। এদিকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের লাল তালিকার তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রজাপতির ৩০৫টি প্রজাতি রয়েছে। তবে এর মধ্যে কিছু কিছু প্রজাতি অনুকূল পরিবেশের অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
প্রজাপতিরা খাদ্যের স্বাদ পরীক্ষা করতে পা ব্যবহার করে থাকে। এরা ফুল থেকে মিষ্টি তরল (মধু), শর্করা ও খনিজ পদার্থ গ্রহণ করে। প্রজাপতি স্যাঁতসেঁতে জায়গা থেকে পানি পান করে পানিশূন্যতা মেটায়। প্রজাপতি খাদ্যশৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। প্রজাপতির লার্ভা (শুঁয়াপোকা) পাখি, ব্যাঙ, টিকটিকির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা খাদ্য শৃঙ্খলকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া প্রজাপতি পরাগায়নের মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে থাকে। এতে প্রকৃতি প্রসারিত হয়।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আমির হোসেন বলেন, প্রজাপতি মূলত এক ধরনের কীট। এদের রং-বেরঙের পাখা ও উড়ন্ত নৃত্য যে কাউকে সহজেই আকৃষ্ট করে। খাদ্যশৃঙ্খলে প্রজাপতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই কোনো অঞ্চলে প্রজাপতির সংখ্যা হ্রাস পেলে খাদ্যশৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাস্তুতন্ত্রের ওপর।
তিনি আরও বলেন, প্রজাপতির সংখ্যা এবং প্রজাপতির বৈচিত্র্য একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য কেমন তা নির্দেশ করে। তাই প্রজাপতি যেন বিপন্ন না হয়ে পড়ে সেজন্য প্রজাপতির বাসযোগ্য পরিবেশ সুস্থ রাখতে কীটনাশক প্রয়োগে আরও সতর্ক হতে হবে, এবং বনাঞ্চল উজাড় না করে সংরক্ষণ করতে হবে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, প্রজাপতি প্রকৃতি ও পরিবেশের বন্ধু। প্রাণিকুলে অনিন্দ্যসুন্দর যেসব পতঙ্গ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রজাপতি। ফুল আর পত্রপল্লবে প্রজাপতির বিচরণ মানুষের মনে এক অন্যরকম অনুভূতি এনে দেয়। প্রজাপতির উপস্থিতি প্রকৃতিকে অলংকৃত করে।
তিনি আরও বলেন, প্রজাপতি উদ্ভিদের পরাগায়নকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পরাগায়নের মাধ্যমে এরা বিভিন্ন উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উদ্ভিদকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে থাকে। এরা পরাগায়নের মাধ্যমে উদ্ভিদ প্রজাতির বংশবিস্তার ত্বরান্বিত করে প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করে তোলে যা সামগ্রিকভাবে পরিবেশের জন্য উপকারী।
কৃষি কর্মকর্তা বলেন, প্রজাতির বাচ্চা (শুঁয়োপোকা বা লার্ভাগুলো) পাতা ও ফুল খেয়ে ফসল নষ্ট করে। প্রজাপতির লার্ভা বা শুঁয়োপোকাগুলো ফসলের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে এবং কিছু ক্ষেত্রে কাঁচা ফলও ছিদ্র করতে পারে, যা ফলন কমিয়ে দেয়। অধিকাংশ প্রজাপতির লার্ভা বা শুয়ো পোকাগুলো ফসলের জন্য ক্ষতিকর।
মাসুদ রানা বলেন, প্রজাপতি পরিবেশের বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। এজন্য পরিবেশে প্রজাপতির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ওপর নির্ভর করে ওই পরিবেশের ভালো-মন্দ। পরিবেশগত সুস্থতা বুঝতে প্রজাপতির উপস্থিতি লক্ষণীয়।
তিনি বলেন, প্রজাপতিদের সংখ্যা কমে যাওয়া পরিবেশের জন্য এক ধরনের বিপদ সংকেত। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ুর পরিবর্তন, গাছপালা নিধনের মাধ্যমে বন উজাড়ের কারণে প্রজাপতির নিরাপদ আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। এজন্য প্রজাপতি সংরক্ষণে পর্যাপ্ত বৃক্ষ রোপণ, গাছপালার ওপর অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার কমানো এবং প্রজাপতির বাসযোগ্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।