অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন, ভূমিকম্পে বড় ক্ষতির শঙ্কা

2 months ago 5

দেশের তিনটি প্রধান ভূমিকম্প বলয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ফল্ট হচ্ছে টাঙ্গাইলের ‘মধুপুর ফল্ট’। এটি তরমুজের ফালির মতো অসংখ্য প্লেটে বিভক্ত। এ ফল্ট থেকে যদি ভূমিকম্প হয় তবে সেটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ভূমিকম্প আশঙ্কার মধ্যেই অপরিকল্পিতভাবে টাঙ্গাইলে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। এতে ঝুঁকি বাড়ছে টাঙ্গাইল শহরের।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় ১২, ১৪ থেকে ১৮ তলা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। ইতোমধ্যে অনেক বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। এসব বহুতল ভবন একাধিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের যৌথ মালিকানায় গড়ে উঠছে। এসব ভবন নির্মাণে পৌরসভার অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ভবনের ভার বহনের ক্ষমতা যাচাইসহ এর স্থাপত্য, কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক, মেকানিক্যাল, প্লাম্বিং, অগ্নিনিরাপত্তার নকশা অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ভবনের নকশার অনুমোদন নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ ভবন গা ঘেঁষে নির্মিত হচ্ছে।

পৌরসভার একাধিক সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত উচ্চ ভবনের প্ল্যান পাস হয়েছে মাত্র ৩০টি। আবেদন জমা পড়েছে ৫৫০টি। তবে অসংখ্য ভবন নির্মাণ কাজ চলছে বলেও এসব সূত্র নিশ্চিত করে।

‘মধুপুর ফল্ট যে কোনো সময় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। ঢাকা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর অঞ্চলে ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা রয়েছে। ফলে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকাসহ আশপাশের অনেক জেলা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, মধুপুর ফল্ট যে কোনো সময় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। ঢাকা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর অঞ্চলে ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা রয়েছে। ফলে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকাসহ আশপাশের অনেক জেলা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এরমধ্যে কিছু ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল টাঙ্গাইলের মধুপুরে।

অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন, ভূমিকম্পে বড় ক্ষতির শঙ্কা

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টাঙ্গাইলে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল এ মধুপুর। উপজেলার গড় এলাকার বোকারবাইদ গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বক্রাকারে তিন থেকে চার ইঞ্চি ব্যাসার্ধের প্রায় আধা মাইল দীর্ঘ এ ভূ-ফাটল দেখা দিয়েছিল। এ ফাটলের গভীরতা ছিল ১৫ থেকে ২০ ফিট। এর আগে সর্বপ্রথম মধুপুর ফল্টে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হয়েছিল।

২০১০ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, মধুপুর ফল্টে রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ৩১৬টি পাকা ভবন ধসে যেতে পারে এবং আংশিক ক্ষতি হতে পারে ৫৬ হাজার ১৬৬টি ভবনের।

‘২০২৪ সালের জুন মাস থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত উচ্চ ভবনের প্ল্যান পাস হয়েছে মাত্র ৩০টি। আর আবেদন জমা পরেছে ৫৫০টি। তবে অসংখ্য ভবন নির্মাণ কাজ চলছে।’

২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে পরিচালিত আরেক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে টেকটোনিক প্লেটের সীমানায় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের দুই লাখ ৩৮ হাজার ১৬৪টি ভবন ধসে পড়তে পারে।

অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন, ভূমিকম্পে বড় ক্ষতির শঙ্কা

সংশ্লিষ্টরা বলেন, শহরের বেশির ভাগ ভবনের কোনো অনুমোদন নেই। যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়নি। বর্তমানে যেগুলো নির্মাণ হচ্ছে সেগুলোও বেশিরভাগ নিয়ম না মেনেই করা হচ্ছে। এছাড়াও অনেক অলিতে গলিতেও বহুতল ভবন তৈরি করা হয়েছে। এতে যদি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় তাহলে বহু হতাহত আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও এসব স্থানে পৌঁছাতে পারবে না। আবার ফায়ার সার্ভিসের তেমন সক্ষমতাও নেই।

আদি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউসুফ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিম বাদ দিয়ে, পর্যাপ্ত ওয়ালও ব্যবহার না করে ফ্ল্যাট-স্ল্যাবের বিল্ডিং ডিজাইন করা বিপজ্জনক। আমাদের দেশে পর্যাপ্ত সাইসমিক ডিটেইলিং ছাড়া বিল্ডিং অহরহ হচ্ছে। বিশেষ করে যে সব বিল্ডিং কোন রেজিস্টার্ড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এর ডিজাইন ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে। অনেক বিল্ডিং মালিক হয়ত মিস্ত্রি বা অন্য কারো প্ররোচনায় ডিজাইনের খরচ বাঁচাতে বিল্ডিং করে ফেলছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে অধিক ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বিল্ডিং নির্মাণে স্পেশাল মোমেন্ট ফ্রেম ব্যবহার করা হয়। সেখানে ফ্ল্যাট-স্ল্যাবকে ল্যাটারাল লোড রেস্টিং সিস্টেমের অংশ হিসেবে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’

‘এক বছরে পৌরসভায় প্রায় ২০টি বহুতল ভবন অনুমোদনের আবেদন জমা পড়েছে। সেগুলোর এখনও অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আগে যে কয়টি আবেদন জমা পড়েছিল সেগুলো আগের মেয়র অনুমোদন দিয়ে গেছেন। অনুমোদন না নিয়ে যে কয়টি ভবনের কাজ চলছে তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

টাঙ্গাইল পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক বছরে পৌরসভায় প্রায় ২০টি বহুতল ভবন অনুমোদনের আবেদন জমা পড়েছে। সেগুলোর এখনও অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আগে যে কয়টি আবেদন জমা পড়েছিল সেগুলো আগের মেয়র অনুমোদন দিয়ে গেছেন। অনুমোদন না নিয়ে যে কয়টি ভবনের কাজ চলছে তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন,‘ পৌরসভার সর্বোচ্চ ১০ তলা ভবন অনুমোদন দেওয়ার বিধান রয়েছে। এর বেশি তলার ভবনের অনুমোদনের ক্ষমতা আমাদের নেই। এজন্য বহুতল ভবনের আবেদন জমা রাখা হচ্ছে। পরবর্তীতে কোনো সিদ্ধান্ত আসলে সেটার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আগের মেয়র কিছু ভবনের অনুমোদন দিয়েছে।’

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভূমিকম্পের ভয়াবহতা বিবেচনায় মধুপুর ফল্ট এলাকায় বসতি স্থাপনায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। এসব অঞ্চলে স্বল্প উচ্চতার ভবন নির্মাণ করে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ পরিহার করা উচিত। ভবনের নকশায় পরিবর্তন ও শক সহনশীল নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’

অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন, ভূমিকম্পে বড় ক্ষতির শঙ্কা

টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভূঞা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শহরের বেশির ভাগ বহুতল ভবন যথাযথভাবে নির্মাণ করা হয়নি। আমাদের অনুমোদন ছাড়াই অনেক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেফটি প্ল্যানও ঠিক মত করা হয়নি। ইতোমধ্যে যেগুলো করা হয়েছে প্ল্যানের মধ্যে দুটি সিঁড়ি উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে অনেক ভবন একটি সিঁড়ি দিয়ে নির্মাণ কাজ করেছে।’

যে সব অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ হচ্ছে তাদের কাজ বন্ধ রাখার জন্য একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কাজ বন্ধ না রাখলে যেগুলো ভাঙার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বড় ধরনের ভূমিকম্প ও দুর্ঘটনা ঘটলে এসব বহুতল ভবনে অনেক হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে। রাস্তা সরু থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরাও পৌঁছাতে পারবে না।’

টাঙ্গাইল পৌরসভার প্রশাসক শিহাব রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে সব অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ হচ্ছে তাদের কাজ বন্ধ রাখার জন্য একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কাজ বন্ধ না রাখলে যেগুলো ভাঙার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শম্ভু রাম পাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পর কোনো বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বর্তমানে সেগুলো নির্মাণ হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অনেক আবেদনও জমা পড়েছে। যারা বিধি মোতাবেক করা করছেন না তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরএইচ/জেআইএম

Read Entire Article