অপরিকল্পিত নগরায়নে ধুঁকছে কুমিল্লা নগরী

3 months ago 14

সিটি করপোরেশন ঘোষণার ১৪ বছরেও পরিকল্পিত কোনো উন্নয়ন হয়নি কুমিল্লায়। গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ভবন। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। মার্কেটের ওপর গড়ে উঠছে বসতবাড়ি। দোকানপাটের আকার-আয়তনের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। একই অবস্থা আবাসিক এলাকার বাড়িঘর নিমার্ণেও।

নগর বিশ্লেষকদের দাবি, কুমিল্লা সিটিতে বসবাসকারীদের ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি নাগরিক সুবিধা। বিশেষ করে নগরীর প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা, যানজট সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

‘নগরীতে প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনই নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। বিনা অনুমতিতে নির্মিত হয়েছে পাঁচ শতাধিকেরও বেশি ভবন। শতাধিক ভবন অতি পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে’

নগরী ঘুরে দেখা গেছে, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের কারণে রাস্তাগুলো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। ছোটবড় ড্রেনের ওপর বসেছে দোকান-পাট। পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুযোগ নেই। ভরাট হয়ে গেছে ছোট-বড় অসংখ্য পুকুর। এতে নগরীতে জলাবদ্ধতা বেড়েছে।

সূত্রমতে, ১৭৯০ সালে কুমিল্লা পৌর প্রশাসনের ইতিহাস শুরু। ১৮৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা পৌরসভা ছিল শহরের প্রথম প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান। প্রায় ১২১ বছরের বেশি সময় কুমিল্লা শহর পৌরসভা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছিল। কুমিল্লার রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক গুরুত্ব এবং জনসংখ্যাও ব্যাপকহারে বেড়েছে এই সময়ে। ২০১১ সালের ৬ জুলাই স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে কুমিল্লাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। ১০ জুলাই বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন আইনের বিষয়টি প্রকাশিত হয়।

এরপর নিয়োগ দেওয়া হয় প্রশাসক। পরে টানা দুবার নির্বাচনে বিএনপি থেকে মেয়র নির্বাচিত হন মনিরুল হক সাক্কু। ২০২২ সালের ১৫ জুন তৃতীয় নির্বাচিনে সাক্কুকে হারিয়ে বিজয়ী হন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত। ১৮ মাস পর ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এরপর ২০২৪ সালের ৯ মার্চ উপনির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের মেয়ে তাহসিন বাহার সুচনা। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের আয়তন ৫৩ দশমিক শূন্য ৪ বর্গকিলোমিটার। ২৭টি ওয়ার্ডে বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষাধিকেরও বেশি মানুষের বসবাস।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, নগরীতে প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনই নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। বিনা অনুমতিতে নির্মিত হয়েছে পাঁচ শতাধিকেরও বেশি ভবন। শতাধিক ভবন অতি পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

‘নামেই সিটি করপোরেশন। দীর্ঘ সময়ের পরও এখানে পরিকল্পিত নগরী গড়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ওয়াসা কী, কুমিল্লার মানুষ চেনেই না! ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে ইচ্ছামতো। জলাবদ্ধতা ও যানজট সমস্যা তো আছেই’

এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সায়েম ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘পৌরসভার শেষ সময় থেকে অনিয়ম চর্চা শুরু হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর যারা জনপ্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলেন তারা চাইলে এই অনিয়ম বন্ধ করতে পারতেন। বর্তমানে জনবল সংকট রয়েছে। এ কারণে নকশা অনুমোদনের পর সঠিকভাবে আমাদের পক্ষে তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও সাধ্যমতো আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চলিক কমিটির সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নামেই সিটি করপোরেশন। দীর্ঘ সময়ের পরও এখানে পরিকল্পিত নগরী গড়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ওয়াসা কী, কুমিল্লার মানুষ চেনেই না! যত্রতত্র বর্জ্য অপসারণ। ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে ইচ্ছামতো। জলাবদ্ধতা ও যানজট সমস্যা তো আছেই।’

আনিছুর রহমান নামের স্থানীয় একজন বাসিন্দা জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘অপরিকল্পিত দালান-কোঠা নির্মাণ আর পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীতে প্রধান সড়কসহ অলিগলি ডুবে যায়। অথচ বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো চিন্তা নেই। শুধু টেক্সের হারই বেড়েছে, কোনো সুবিধা বাড়েনি।’

অপরিকল্পিত নগরায়নে ধুঁকছে কুমিল্লা নগরী

সাইফুল ইসলাম নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘নগরীর পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন ও নালা তৈরিতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে সিটি কপোরেশন কর্তৃপক্ষ। অথচ সামান্য বৃষ্টিতেই পানির নিচে ডুবে যায় পুরো নগরী। এমন লোক দেখানো কাজের কী দরকার! এটি রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় আর নিজেদের পকেট ভারী করার ধান্দা ছাড়া আর কিছুই না।’

কুমিল্লা একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। সে হিসেবে সিটি করপোরেশন হওয়ার পর অবকাঠামোগত তেমন কোনো উন্নয়নই হয়নি বলে জানান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এন এম রবিউল আউয়াল চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘এখনো সময় আছে পরিকল্পিত নগরী গড়ার। পরিকল্পনা করে আমাদের এগোতে হবে। তা নাহলে আগামীতে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে কুমিল্লা নগরী।’

নগরবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, আজকের যে কুমিল্লা অন্তত ২০০ বছর আগের অবকাঠামো সংস্কার করেই চালানো হচ্ছে। আগামী শতকের উপযোগী করে যে কুমিল্লা বিনির্মাণের প্রয়োজন তার কোনো উদ্যোগ নেই।

তিনি বলেন, শহরে ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে জনসংখ্যা। এখনই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। জনসংখ্যার ভারে নগরীতে যানজট আর জনজট এখন প্রতিদিনের চিত্র। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এখনি উদ্যোগ নিতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সায়েম ভুঁইয়া বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের মধ্যে যেসব ড্রেন রয়েছে, সেগুলো পরিষ্কারের জন্য কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। নগরীকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হবে।

এসআর/জিকেএস

Read Entire Article