অবৈধ অভিবাসীদের জন্য ‘নিরাপদ দেশের’ খোঁজে জার্মানি

2 weeks ago 12

ইউরোপীয় বিচার আদালতের এক রায়ে অনিয়মিত অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকা প্রণয়নে জার্মান সরকারের পরিকল্পনা বাধার মুখে পড়তে পারে।

জার্মান সরকার বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল্যায়নে একটি দেশ তখনই নিরাপদ, যখন দেশটির কোনো নাগরিককে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ভয়ে থাকতে হয় না। এ ধরনের মূল্যায়ন কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। আর সেই বিতর্কের অবসান হয় আদালতে।

১ আগস্ট ইউরোপীয় বিচার আদালত (ইসিজে) এক রায়ে বলেছেন, একটি দেশকে ‘নিরাপদ’ ঘোষণা করতে হলে সেই দেশটিতে সংখ্যালঘুসহ সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা রয়েছে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।

লুক্সেমবুর্গভিত্তিক আদালতটি ওই রায়ে উল্লেখ করেছে, আশ্রয় আবেদন দ্রুত সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ইইউ আইনের লঙ্ঘন না হলেও, নিরাপদ দেশগুলোর নাম বিচারিক তদন্তের আওতায় আনার সুযোগ থাকতে হবে, যেন কোনো আশ্রয়প্রার্থী তাদের আশ্রয় আবদেন প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।

‘নিরাপদ দেশের’ একটি তালিকা তৈরি করেছে জার্মানি। এমন নিয়মে করা হয়েছে, যার ফলে, তালিকাভুক্ত দেশগুলো থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের জার্মানিতে আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। জার্মানির করা ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকায় বর্তমানে ইইউর সদস্য নয় এমন আটটি ইউরোপীয় দেশের নাম রয়েছে। এছাড়া, দুটি আফ্রিকান দেশের নামও রয়েছে তালিকাটিতে।

দীর্ঘ হতে পারে ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকা

রক্ষণশীল সিডিইউ/সিএসইউ এবং মধ্য-বামপন্থি এসপিডি-র সমন্বয়ে গঠিত জার্মানির নতুন জোট সরকার ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকায় আরও কয়েকটি দেশের নাম যুক্ত করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে।

বিবেচনায় রয়েছে আলজেরিয়া, ভারত, মরক্কো এবং টিউনিশিয়ার নাম।

জোট সরকার গঠনের চুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘কোন কোন দেশ ‘নিরাপদ দেশ’ ঘোষণার শর্ত পূরণ করছে, সেদিকটায় আমরা নজর রাখছি। বিশেষ করে, গত পাঁচ বছরে যেসব দেশের নাগরিকদের আশ্রয় আবেদন মঞ্জুরের হার পাঁচ শতাংশের নিচে, সেসব দেশকে ‘নিরাপদ দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে।’

কিন্তু ইউরোপীয় বিচার আদালতের দেয়া রায়ের কারণে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যতটা সহজ বলে মনে হচ্ছিল, ততটা সহজ হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে৷

জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ইসিজে-র দেওয়া রায়টি পর্যালোচনা করা হবে।

একটি দেশকে ‘নিরাপদ’ ঘোষণার প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের সংস্কার আনতে যাচ্ছে জার্মান সরকার। ভবিষ্যতে কোনো দেশকে ‘নিরাপদ’ ঘোষণা করা হলে, সরকার একটি ডিক্রি জারি করে তা জানিয়ে দেবে। এর অর্থ হলো, এই বিষয়ে জার্মান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘বুন্ডেসটাগ’ বা উচ্চকক্ষ ‘বুন্ডেসরাট’ কোনো মতামত জানাতে পারবে না।

আশ্রয় আইনের সংস্কার চান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি গতিশীল করতে একটি বিলের খসড়া পার্লামেন্টে উত্থাপন করেছে জোট সরকার। জুলাইয়ে এই বিলটি নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনাও হয়েছে। গ্রীষ্মের ছুটির পর সংসদ অধিবেশন শুরু হলে এই ইস্যুতে ভোটাভুটি হতে পারে।

জার্মানিতে আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে এমন অনেক অভিবাসীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এই ইস্যুতে ভীষণ ক্ষুব্ধ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ডট। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এখন আমাদের লক্ষ্য হলো, অনিয়মিত অভিবাসন কার্যকরভাবে সীমিত করার পথে সব বাধা দূর করা।’

জার্মানির বর্তমান আইন অনুসারে, যেসব ব্যক্তিকে দেশ ছাড়তে বলা হয়েছে, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর আগে আইনি আশ্রয় চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই বিধানটি বাতিল করতে চায় সরকার। ডোব্রিন্ডট আশা করছেন, এমন প্রেক্ষাপটে ‘নিরাপদ’ হিসাবে তালিকাভুক্ত দেশগুলোতে অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা আসবে না।

প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের প্রত্যাবাসনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে ‘রিটার্ন হাব’ বা যৌথ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা চলছে জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে। গত জুলাইয়ে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে এক বৈঠকে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

ইইউর এমন পরিকল্পনায় পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন ডোব্রিন্ডট। তিনি বলেছেন, একটি দেশের পক্ষে একা ইইউর বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে রিটার্ন হাব নির্মাণ করা কঠিন। কিন্তু জোটের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা অনেক সহজ।

‘যারা যোগ্য নন, তাদের আসা উচিত নয়’

ডোব্রিন্ডট বলেন, অতীতে জার্মানিতে আসা অনেক আশ্রয়প্রার্থী আশ্রয়ের জন্য যোগ্য ছিলেন না। তিনি আশা করেন, পরিকল্পিত সংস্কার একটি স্পষ্ট বার্তা দেবে: ‘যারা নিরাপদ দেশ থেকে আসছেন, তাদের যাত্রা করা উচিত নয়। যারা আশ্রয়ের যোগ্য নন, তাদের আসা উচিত নয়।’

জার্মানির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আশা করছে, ইউরোপীয় বিচার আদালতের দেওয়া এই রায় জার্মান সরকারকে তার আশ্রয়নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করবে।

গ্রিন পার্টির আইনপ্রণেতা ফিলিৎস পোলাট বলেন, ‘নিরাপদ দেশ নিয়ে ইউরোপীয় বিচার আদালতের রায় মানবাধিকার এবং ইউরোপে আশ্রয় অধিকার রক্ষায় একটি বড় সাফল্য।’

তিনি আরও বলেন, বুন্ডেসটাগ এবং বুন্ডেসরাট-এর অনুমোদন ছাড়া সরকারি নির্দেশে কোনো দেশকে ‘নিরাপদ ঘোষণা’ করার পরিকল্পনাও উচিত নয়।

জর্জিয়া ও মলদোভা নিরাপদ নয়: ডি লিংকে

নিরাপদ দেশের তালিকার তৈরির ক্ষেত্রে জোট সরকারকে একটি বিস্তৃত পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়েছেন বামপন্থি দল ডি লিংকে-র নেত্রী ক্লারা ব্যুঙ্গার। তিনি বলেন, ‘জর্জিয়া ও মলদোভাকে অবিলম্বে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।’

আবখাজিয়া এবং সাউথ ওসেটিয়ার মতো বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোতে বিদ্যমান মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই এমন মন্তব্য করেছেন এই বামপন্থি রাজনীতিবিদ।

এমনকি ইইউ সদস্য রাষ্ট্র চেকপ্রজাতন্ত্রও মলদোভার কিছু অংশকে নিরাপদ বলে মনে করে। কারণ, ট্রান্সনিস্ট্রিয়া অঞ্চলটি রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। ফলে, দেশটিকে পূর্ণ নিরাপদ মনে করা হয় না।

ব্যুঙ্গার বলেন, ইসিজে-র এই রায় ‘টিউনিশিয়া এবং আলজেরিয়ার মতো অন্যান্য দেশগুলোকেও নিরাপদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে ফেডারেল সরকারের পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করে।’

কারণ, তিউনিশিয়া এবং আলজেরিয়ায় সমকামিতা আইনিভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই দেশগুলোকে নিরাপদ হিসাবে তালিকাভুক্ত করা ইউরোপীয় বিচার আদালতের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এমআরএম/এমএস

Read Entire Article