অভিনব পন্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি, অর্ধকোটি টাকা ঋণ নিয়ে লাপাত্তা

3 weeks ago 19

বাংলাদেশ ব্যাংকের সিলেটে অফিসে ভুয়া পরিচয়ে চাকরি করেছেন এক যুগ। ভুয়া পরিচয়পত্র ও জাল সনদে চাকরি নিলেও এক যুগেও ধরা পড়েনি। হেলপার টু প্লাম্বার পদে চাকরি নিয়ে পেয়েছেন পদোন্নতি, ভোগ করেছেন ব্যাংকের সব সুযোগ-সুবিধা। চাকরিতে থাকা অবস্থায় গৃহনির্মাণের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, যা সুদসহ বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৬১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এই টাকা পরিশোধ না করে তিনি এখন গা ঢাকা দিয়েছেন।

অভিযুক্ত ব্যক্তি চাকরিতে যোগদানের সময় দাখিল করা তথ্য অনুসারে, তার নাম মো. ফারুক মিয়া। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার গান্দিনা গ্রামে। তারা বাবার নাম মো. আনোয়ার হোসেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, তার প্রকৃত নাম মিনহাজ মিয়া। তিনি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের উত্তরপাড়া বালিয়া গ্রামের মো. আব্দুল জলিল মিয়ার ছেলে।

এ অবস্থায় গত শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) সিলেট কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ গোলজার হোসেন।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সিলেটের একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে মজুরিভিত্তিক (কাজ নেই, মজুরি নেই) একজন হেলপার টু প্লাম্বার নিয়োগের নিমিত্তে প্যানেল প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশি নাগরিকদের থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি আবেদন করেন মো. ফারুক মিয়া। পরে তিনি নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন যুগ্ম ব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) মো. নুরুল ইসলামের সই করা ফারুক মিয়ার স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় নিয়োগপত্র পাঠানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ মে হেলপার টু প্লাম্বার পদে যোগদান করেন তিনি।

নিয়োগের সময় ফারুক মিয়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ২০০৯ সালে এসএসসি সনদ দাখিল করেন। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২৪১২৪৩/২০০৬। এটি বাংড়া উচ্চবিদ্যালয়ের সত্যয়ন করা ছিল। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট অফিসের ২০১৮ সালের ১২ জুন কর্মচারী নির্দেশে (নম্বর ৯১/২০১৮) ফারুক মিয়াকে নিয়মিত পদে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং চাকরিবিধি অনুযায়ী পুলিশ প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে তাকে স্থায়ী করা হয়।

অভিযোগে বলা হয়, চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর মো. ফারুক মিয়া গৃহনির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুই কিস্তিতে ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। এরপর ২০২৩ সালের ৬ জুন থেকে তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তার অনুপস্থিতির কারণ ও ঋণের কিস্তি ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফারুক মিয়ার নামীয় জমি ক্রয়কালে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমা দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ভুয়া ও অস্তিত্বহীন।

পরে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইকালে দেখা যায়, মো. ফারুক মিয়ার প্রকৃত নাম মিনহাজ মিয়া। তিনি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের উত্তরপাড়া বালিয়া গ্রামের মো. আব্দুল জলিল মিয়ার ছেলে। ফারুক মিয়া চাকরিতে যোগদানের সময় ভুয়া সনদ, ভুল তথ্য ও জাল কাগজপত্র দাখিল করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেছেন। তিনি জাল শিক্ষাসনদ ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।

অভিযোগে বলা হয়, ফারুক মিয়া বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট অফিসের প্রকৌশল বিভাগে পদোন্নতি পেয়ে হেলপার-টু-প্লাম্বার প্রথম মান পদে কর্মরত থাকাবস্থায় গত বছরের ৬ জুন থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তার স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় ব্যাংকের সংস্থাপন শাখা থেকে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ‘প্রাপক অন্যত্র চলিয়া গিয়াছে তাই ফেরত’ মর্মে চিঠি ফেরত আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. ফারুক মিয়া টাঙ্গাইলের কালিহাতী গান্দিনা গ্রামের মো. আনোয়ার হোসেনের ছেলে এবং মিনহাজ মিয়া টাঙ্গাইলের বাসাইল থানার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল মিয়ার ছেলে। ফারুক মিয়াকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তার শিক্ষাসনদ সংগ্রহ করেছিলেন মিনহাজ মিয়া। এরপর ফারুকের নামে নিজেই চাকরি করতে থাকেন।

এদিকে প্রকৃত ফারুক মিয়া তার চাকরি না হওয়ায় (জানতেন না মিনহাজ তার নামে চাকরি করছেন) প্রবাসে চলে যান।

এদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি নেওয়া মিনহাজ মিয়ার মামা সাইফুল ইসলাম মিয়াও বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের প্রকৌশল শাখায় কর্মরত ছিলেন। মূলত তিনিই তার ভাগনে মিনহাজকে ফারুক মিয়া নামে বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের কর্মকর্তাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। সে সূত্র ধরেই ফারুকের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পান মিনহাজ। এ ঘটনার পর সাইফুল ইসলাম মিয়াকেও ব্যাংক থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে মিনহাজ মিয়ার মামা সাইফুল ইসলাম দাবি করে বলেন, আমি ঘটনাটি জানতাম না। মিনহাজের সার্টিফিকেটে কিছু ভুল ছিল। তার নাম মিনহাজ আর স্কুলের সার্টিফিকেটে ছিল ফারুক। এ বিষয়টা সে আমাকেও বলেনি।

কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জিয়াউল হক কালবেলাকে বলেন, ভুয়া পরিচয়ে এক যুগ একজন মানুষ কীভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করল, বুঝতে পারছি না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক ও তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ গোলাম মাহমুদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, এ ঘটনা সত্য। তবে দায়িত্ব নিয়ে বেশি কিছু বলতে পারবো না। যেহেতেু অপরাধী ধরা পড়েছে, ফৌজদারি অপরাধে তার শাস্তি হবে।

তিনি আরও বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে পুলিশ প্রার্থীর কাগজপত্র ভেরিফিকেশন করেছে।

Read Entire Article