রিতা থাকেন খুলনার প্রান্তিক উপজেলা দাকোপে। দীর্ঘদিন চর্মরোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসায় উপকার না হওয়ায় তৃতীয়বার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। কিন্তু খরচ করে রাজধানী পর্যন্ত যেতে হয়নি তাকে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেই ভিডিও কলে সেখানকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেন মাত্র ১০ টাকায়।
এভাবেই ইন্টারনেটভিত্তিক টেলিমেডিসিন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ২৩৩টি সেন্টারের মাধ্যমে উপজেলায় থেকেই রিতার মতো প্রান্তিক রোগীরা পাচ্ছেন মানসম্পন্ন হাসপাতালের সেবা। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ভিডিও কলের মাধ্যমে চর্মরোগ, ডায়াবেটিসসহ ৭০টির বেশি রোগের চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন।
অর্থ সংকটে থমকে যাচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী এ প্রকল্পটি। দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়ায় অনেক কর্মী সেন্টারে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কিছু সেন্টার এখনো টিকে আছে স্বেচ্ছাশ্রমে। তাদের একটি দাকোপের এই সেন্টার।
দাকোপ টেলিমেডিসিন সেন্টারের পরিচালনাকারী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘ আট মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। আমাদের পেটে ভাত নেই। আমাদের কথা শোনার কেউ নেই। তারপরেও সেন্টারটি চালু রেখেছি। কারণ, রোগীরা আসেন। তাদের কথা ভেবে বাসায় বসে থাকতে পারি না।’
মা অনেকদিন চর্মরোগে ভুগছিলেন। উপজেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ না থাকায় ভিডিও কলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল, যা আমাদের মতো মানুষের জন্য ছিল এক অভাবনীয় সুযোগ। ইন্টারনেট না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।–রোগী রিতার ছেলে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়, এরপর সরকার পরিবর্তনের কারণে নতুন করে অর্থ বরাদ্দ আসেনি। ফলে কার্যত বন্ধ রাখতে হচ্ছে এই সেবা। তবু কিছু স্টাফ দীর্ঘদিন ধরে বিনা বেতনে কাজ করায় অল্প কিছু সেন্টার চালু রয়েছে।
সম্প্রতি ইউএসএআইডির সহায়তা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তবে কর্মকর্তারা জানান, টেলিমেডিসিন প্রকল্পটি মূলত সরকারের অর্থায়নে চলছিল। পলিসিগত সিদ্ধান্তের অভাবেই এখন এটি ঝুলে আছে।
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পেলেও ২০২৫ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ৭১ মিলিয়নে, যার প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্যখাতের বহু উদ্যোগে।
বিশেষজ্ঞ সংকটে ভরসা ছিল টেলিমেডিসিন
ঢাকা থেকে ২৪০ কিলোমিটার দূরে দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দোতলায় টেলিমেডিসিন সেন্টারটির সামনে রোগীদের ভিড়। চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগে ভুগছেন তারা। হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার তাদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে রেফার করেছেন।
এখনো এমন অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখান থেকে মানুষের এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও আসা কঠিন। তাদের জন্য এ সেবা কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া উচিত। সেখানে এ সেবা থমকে আছে।- মংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শাহীন
ভিতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, একটি বড় এলইডি মনিটরের সামনে রোগীসহ একজন মেডিকেল অফিসার বসে আছেন। তিনি ভিডিও কলে অপর প্রান্তে নওগাঁ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে যুক্ত হওয়া একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে তার সঙ্গে থাকা রোগীর চর্মরোগ সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোগীকে কিছু ওষুধ সাজেস্ট করেন। মেডিকেল অফিসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে ওষুধ লিখে দেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে এসব ওষুধ রোগীকে সরবরাহ করা হয়।
- আরও পড়ুন
- কমিউনিটি ক্লিনিককে আরও আধুনিকায়ন করছে সরকার
- ওপি বাতিলের সিদ্ধান্তে আরও ‘অসুস্থ’ স্বাস্থ্যখাত
- আমরা টেলিমেডিসিন, শিক্ষাসহ নানান সুবিধার দুয়ার উন্মোচন করেছি
টেলিমেডিসিন সেন্টার কক্ষটিতে একটি কম্পিউটার, ভিডিও কনফারেন্সিং কোডেক, এসএফপি ট্রান্সিভার (ফাইবার মডিউল) ও একটি ইউপিএস দেখা যায়।
রিতা গাইনের ছেলে কিংকর গাইন বলেন, ‘মা অনেকদিন চর্মরোগে ভুগছিলেন। উপজেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ না থাকায় ভিডিও কলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল, যা আমাদের মতো মানুষের জন্য ছিল এক অভাবনীয় সুযোগ। ইন্টারনেট না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রাম থেকে দাকোপ হাসপাতালে আসতেই লাগে ২-৩ ঘণ্টা, নদী পার হতে হয়, খরচ হয় প্রায় ৩০০ টাকা। খুলনা বা ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব।’
টেলিমেডিসিন সেবাটি আমাদের অপারেশন প্ল্যানের (ওপি) অধীনে ছিল। বর্তমানে অপারেশন প্ল্যান সব বন্ধ করা হয়েছে। তবে এই সেবা কার্যক্রম কীভাবে রাজস্ব খাতের অধীনে আনা যায় সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফর
দাকোপের বট বুনিয়া থেকে আসা রোগী সাগর চন্দ্র সরকার বলেন, ‘৩০ কিলোমিটার দূর থেকে এসে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়া আমাদের জন্য আশীর্বাদ। তবে এখনো অনেকে এই সেবার খবরই জানে না, প্রচারের প্রয়োজন আছে।’
দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুদীপ কুমার বালা বলেন, ‘এখানে ১১ জন কনসালট্যান্টের বিপরীতে মাত্র দুজন আছেন, তাও একজন খুলনায় কর্মরত। এমবিবিএস চিকিৎসকরা যতটুকু পারেন করেন, কিন্তু জটিল রোগীদের জন্য টেলিমেডিসিন ছিল একমাত্র ভরসা।’
এখানে মাসে গড়ে ২৫০-৩০০ রোগী এই সেবা নেন বলে জানান টেলিমেডিসিন সেন্টারের স্টাফ মাহবুবুর রহমান। এদের বেশিরভাগই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের বলে জানান তিনি।
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ বাস করে গ্রামাঞ্চলে, আর ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার প্রোগ্রামার ইশরাত জাহান কাকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১১ সালে আটটি কেন্দ্রে টেলিমেডিসিন সেবা শুরু হয়। এরপর প্রতি বছর ১০টির মতো কেন্দ্র যুক্ত হতে থাকে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৯৪টি কেন্দ্র চালু ছিল, এবং ২০২৩ সালে আরও ১৪০টি নতুন কেন্দ্র যুক্ত হয়। ৩৯টি সেবাদানকারী এবং ১৯৪টি সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান। ঢাকা থেকে পরিচালিত একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষের মাধ্যমে এই কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হয়।’
করোনাকালে সেবাটি জনপ্রিয়তা পায় জানিয়ে ইশরাত জাহান বলেন, ‘তবে ২০২২ সাল থেকে এর কার্যক্রম জোরালোভাবে শুরু হয়। একসময় মাসে ৮-৯ হাজার রোগীর সেবা দিতাম, কিন্তু ২০২৪ সালের জুনের পর থেকে অর্থ সংকটে প্রকল্পটি হোঁচট খেতে শুরু করে।’
সবশেষ ২০২৪ সালে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ৮৩ হাজার ৯৩ জন রোগী এই সেবা গ্রহণ করেন বলে জানান তিনি।
ইশরাত জাহান বলেন, ‘সাধারণত উপজেলা হাসপাতাল কোনো রোগীকে সামলাতে না পারলে প্রথমে জেলা হাসপাতাল ও পরে ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু টেলিমেডিসিনে সরাসরি উপজেলা থেকেই ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে, যা এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল।’
আছে অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রান্তিক মানুষের জন্য এ ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দুর্বল অবকাঠামো ও ধীরগতির ইন্টারনেটও এ সেবার অন্যতম অন্তরায়।
দুর্গম দাকোপে টেলিমেডিসিন সেবা চালাতে হচ্ছে মাত্র ২ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেটে, যা বিটিসিএলের ফাইবার অপটিক সংযোগে সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় কর্মীরা জানান, প্রায়ই ইন্টারনেটের লাইনে সমস্যা দেখা যায় আর সেটি ঠিক হতে কয়েকদিন লেগে যায়। দিনে কয়েকবার করে লোডশেডিং হওয়ার কারণে ভিডিও কলে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়।
দাকোপ টেলিমেডিসিন সেন্টারে ২০১৫ সালে সরবরাহ করা হয়েছিল টেলি স্টেথোস্কোপ, টেলি ইসিজি, গ্লুকোমিটারসহ একাধিক আধুনিক টেলিগ্যাজেট, কিন্তু প্রাসঙ্গিক সফটওয়্যার না থাকায় সেগুলো এখনো বাক্সবন্দি।
এমআইএস কর্মকর্তা জহির আব্বাস জানান, ২০২৪ সালে উন্নত টেলিমেডিসিন সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে, যা মে মাসে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে নেওয়া হয়, তবে প্রকল্পের ফান্ড পাওয়ার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। নতুন সফটওয়ার চালু হলে ডাক্তার সরাসরি সিস্টেমে রোগীর প্রেসক্রিপশন লিখবেন এবং রোগী বা স্বাস্থ্যকর্মী তা ডাউনলোড করতে পারবেন।
‘এছাড়া আইওটি ডিভাইসের মাধ্যমে ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, ওজন, উচ্চতা ইত্যাদি জরুরি তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিস্টেমে যুক্ত হবে, যা চিকিৎসায় আরও নির্ভুলতা ও সুবিধা দেবে। সফটওয়্যার রোগীর তথ্য ডিএইচআইএস২ প্ল্যাটফর্মে রেকর্ড করবে এবং ডাক্তারের শিডিউল ব্যবস্থাপনাও সহজ হবে,’ বলেন তিনি।
শঙ্কায় প্রান্তিক রোগীরা
দাকোপের পার্শ্ববর্তী বাগেরহাটের মংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার টেলিমেডিসিন সেন্টারটি দীর্ঘ চার মাস ধরে বন্ধ। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে বেতন না পেয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চাকরি নিয়েছেন এই সেন্টারের পরিচালনাকারী স্টাফ প্রান্ত মণ্ডল
মংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আউটডোরে কথা হয় মিঠাখালী ইউনিয়ন থেকে আসা উচ্চ রক্তচাপের রোগী শ্যামলী মণ্ডলের (২৮) সঙ্গে। সকাল ৬টায় বাড়ি থেকে রওয়ানা দিয়ে হাসপাতালে এসেছেন, ডাক্তার দেখাতে বেলা ১টা বেজে যেতে পারে বলে জানান তিনি
শ্যামলী বলেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ। দুটো বাচ্চাও ছোট। তাদের রেখে জেলা শহরে যাওয়া কঠিন। টেলিমেডিসিন সেন্টারে এখান থেকে ঢাকা-খুলনার ডাক্তার দেখানো যেত। এসে দেখছি সেটা বন্ধ।’
মংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শাহীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখনো এমন অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখান থেকে মানুষের এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও আসা কঠিন। তাদের জন্য এ সেবা কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া উচিত। সেখানে এই সেবা থমকে আছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব বেসিক সায়েন্স অ্যান্ড প্যারাক্লিনিক্যাল সায়েন্সের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উপজেলা এমনকি জেলা পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয় না। তখন স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা সুবিধা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরির জন্য টেলিমেডিসিন একটি উৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। ২০১১ সালে নেওয়া এ উদ্যোগকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী করা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা হয়নি।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফর জাগো নিউজকে বলেন, ‘টেলিমেডিসিন সেবাটি আমাদের অপারেশন প্ল্যানের (ওপি) অধীনে ছিল। বর্তমানে অপারেশন প্ল্যান সব বন্ধ করা হয়েছে। তবে এ সেবা কার্যক্রমকে কীভাবে রাজস্ব খাতের অধীনে আনা যায় সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।’
জেপিআই/এএসএ/এমএফএ/এএসএম