ভূমধ্যসাগরের তীরে তিউনিসিয়ার এক মনোরম শহর হামামেত, দীর্ঘদিন ধরেই পর্যটকদের জন্য এক স্বপ্নের ঠিকানা। সাদা বালির সৈকত, ফিরোজা জলরাশি, খেজুর গাছের ছায়া এবং শতাব্দীপ্রাচীন মদিনার (পুরোনো শহর) দেওয়াল—সবকিছু মিলিয়ে এটি যেন আধুনিক তিউনিসিয়ার এক উজ্জ্বল মুখচ্ছবি। রোমান, আরব এবং ওসমানীয় সংস্কৃতির ছাপ এখানে এখনো দৃশ্যমান। এই ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণই হামামেতকে করে তুলেছে এক অনন্য গন্তব্য।
হামামেতের অর্থনৈতিক চাকা মূলত পর্যটনকেন্দ্রিক। এই শহরের হোটেল, রিসোর্ট, থ্যালাসোথেরাপি সেন্টার (সাগরজল ও খনিজ লবণ নির্ভর চিকিৎসাকেন্দ্র) এবং বার্ষিক ফেস্টিভ্যালগুলো যেমন ‘হামামেত ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল’ পর্যটকদের আকর্ষণ করে আনে। স্থানীয়দের জীবিকা, বিশেষ করে তরুণদের কর্মসংস্থান, এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু মৌসুমি পর্যটনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা অর্থনীতিকে করে তুলেছে ভঙ্গুর। শুধু গ্রীষ্মকালীন পর্যটন মৌসুমেই আয়ের উৎস সীমাবদ্ধ থাকা দীর্ঘমেয়াদে শহরের আর্থিক স্বনির্ভরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। শীতকালে হোটেলগুলো অনেকাংশেই বন্ধ থাকে, কাজের সুযোগ কমে যায় এবং অনেকেই বাধ্য হন অস্থায়ী পেশায় যুক্ত হতে।
তবুও এই সময়ে পর্যটকদের কোলাহলে ভরা শহর। হামামেতের সৈকতে সমুদ্রস্নানে মেতে ওঠা পর্যটকদের দেখা যায়—আফ্রিকার নানা প্রান্ত, মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশ, ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা ইতালি থেকে আগত সাদা-বাদামি মানুষগুলোর মাঝে নেই কোনো উৎকণ্ঠা। আছে রাশি রাশি উল্লাস, ক্যামেরার ঝলকানি আর ঝাঁক ঝাঁক হাসির আওয়াজ। শহরের পুরোনো অংশে, যেখানে সরু গলির ধারে কার্পেট, সিরামিক আর মসলার দোকান; সেখানে আজও বাতাসে মিশে আছে প্রাচীনতার ঘ্রাণ।
হামামেত আসার দ্বিতীয় দিনটি (২০ জুলাই) তিউনিসিয়ার এ সময়ের অন্যান্য দিনগুলোর মতোই। চকচক করছে রোদ, ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উষ্ণতা নিয়ে সকালে হোটেলে আর্লি ব্রেকফাস্ট সেরে আমাদের যাত্রা শুরু হয় কাইরুয়ান শহরের দিকে। দেড় ঘণ্টার পথ পরিক্রমণের শুরুতে হামামেত শহরের সমুদ্রসৈকত—অর্থাৎ সৈকতঘেঁষা হোটেল—আমাদের ক্রমশ পিছু হটতে থাকে। দ্রুততার সাথেই চলছে মিনিবাস। ১২ জনের আসনের প্রয়োজন হলেও সিট ছিল চৌদ্দটি। সুতরাং ঠাসাঠাসি ছিল না। প্রচণ্ড গরম হলেও ট্যুরিস্ট বাসটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিতই ছিল।
ছুটছে বাস। গাইড ইমাদ তিউনিসিয়ার উচ্চারণকে সাথে রেখেই বলে যাচ্ছেন এই গাছগুলোর কথা ইংরেজিতে। আমাদের পাশ দিয়ে দ্রুত পেছনে সরে যাচ্ছে সারি সারি মাঝারি মাপের সব গাছ। সব গাছই যত্ন করে ছেঁটে দেওয়া। মনে হলো গাছগুলোই যেন তিউনিসিয়ার প্রাণ। যেদিকেই তাকাই, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত প্রান্তরের শুকনো দেশটাকে যেন সজীব রাখছে এই অলিভ গাছ। শুধু বিস্তৃত প্রান্তর নয়, রাস্তার পাশে সামান্য জায়গা থাকলেও সেখানে অলিভ গাছ শোভা পায়। বাংলাদেশে একসময় ধানক্ষেতের মালিকরা যেমন বংশ পরম্পরায় কৃষক হয়ে বিলাসী জীবনযাপন করতেন; ঠিক সেভাবেই এখানকার জমির মালিকেরা আছেন বৈভবের মালিক হয়েই। যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিচর্যা করলে বংশ পরম্পরায় এই জমির মালিকেরা যাপন করতে পারে আয়েশের জীবন।
বিস্ময় লেগেছে; যখন শুনেছি একটি অলিভ গাছ এমনকি এক হাজার বছরও বেঁচে থাকতে পারে। তিউনিসিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান অলিভ তেল উৎপাদক দেশ এবং এখানে আনুমানিক ৮০ মিলিয়নেরও বেশি অলিভ গাছ আছে। গাছগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, বিশেষ করে মধ্য ও দক্ষিণ তিউনিসিয়ায়। অলিভ তেল তিউনিসিয়ার কৃষিখাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি দেশের মোট কৃষি রপ্তানির প্রায় ২০% অবদান রাখে। তিউনিসিয়া বিশ্বের শীর্ষ অলিভ তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে একটি।
একটি অসাধারণ পারিবারিক ভ্রমণে আমরা, যেখানে আমাদের দলে আছেন ১২ জন সদস্য। হামামেতের এক বর্ণিল সমুদ্রসৈকতের গা ঘেঁষা হোটেল থেকে আমরা একে একে কাইরুয়ান, এল জেম এবং সউস শহরগুলোর দিকে এগোচ্ছিলাম। পথের পাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেমন অলিভ গাছে পরিপূর্ণ, ঠিক তেমনই দেখা যায় আবাদহীন মাঠও। হাইওয়ের পাশেই নির্দিষ্ট দূরত্বে সটান দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা বৈদ্যুতিক খুঁটি। গাইড দেখিয়ে দিলেন, প্রায় প্রত্যেকটি খুঁটির ওপরেই তৈরি করা পাখির বাসা। খুঁটিগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা; যেখানে খুঁটির একদম চূড়ায় মোটামুটি বড় করে বাংলাদেশের খড়ের মতো দ্রব্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাসাগুলো। দেখিয়ে দিলেন—লম্বা পায়ের কোথাও একটা, কোথাও দুটো স্টর্ক পাখি (নামটা ইমাদই বললেন) দাঁড়িয়ে আছে। শীতকালের প্রচণ্ড ঠান্ডায় রাশিয়া তথা সাইবেরিয়ান অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে; তখন সেগুলো এভাবেই সারা তিউনিসিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তারা বাসা পেয়ে যায়। পশুদের প্রতি মমতার বিস্ময় জাগানো রাষ্ট্রীয় এ উদ্যোগ আমি কোথাও দেখিনি আগে।
কাইরুয়ানে পৌঁছানোর পর শিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক একটি মসজিদ দেখতে আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। পূর্বে আমাদের উল্লেখিত দর্শনীয় স্থান হিসেবেই গাড়ি থামে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের পাশে। যেটি ১৩শ শতাব্দী থেকে বিচ্ছুরিত করছে শিক্ষার আলো। যখন অন্ধকার আর সাম্রাজ্য দখলের লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত মানবতা, হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে চলছে ইউরোপ কিংবা আফ্রিকার মধ্যযুগীয় সভ্যতা—সে সময়ে মসজিদটি শুধু ধর্মীয় প্রার্থনার স্থানই নয় বরং এটি একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে যায়। হাজার বছরেরও অধিক পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়টি ইসলামি শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। যেখানে বহু পণ্ডিত ও গবেষক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ও শিক্ষা দিয়ে গেছেন। মসজিদের স্থাপত্যশৈলী এবং এর ইতিহাস যে কাউকে মুগ্ধ করবে। মসজিদটি সে সময়ের স্মারক, যা পর্যটকদের জন্য খোলা রাখা হয়। নারীদের স্কার্ফ পরে এখানে প্রবেশ করতে হয়, ভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য স্কার্ফের ব্যবস্থাটাও আছে। ভিন্ন ধর্মের নারীরা রীতিনীতির প্রতি সম্মান রেখেই স্কার্ফ পরছেন। শিয়াদের বার্ষিক একটি উৎসবের আয়োজন করা হয় এখানে। প্রায় ১০-১৫ হাজার শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষের উপস্থিতিতে। সেদিনই গমগম করে ওঠে উপাসনালয়। অধিকাংশ সুন্নি মানুষের আবাস এই তিউনিসিয়া, কিন্তু শিয়া-সুন্নি নিয়ে দেশটিতে নেই কোনো বিভেদ। পারস্পরিক ধর্মীয় সৌহার্দ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মনে হয়েছে এই মসজিদ কিংবা প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থাপনা।
এই মসজিদের পাশেই একটি কবর আছে—ইতিহাসবিদদের মতে, কাইরুয়ানের এই ব্যক্তির নাম ছিল সিদি সাহেব, যিনি ‘নাপিত’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন হজরত মুহাম্মদের (সা.) একজন সাহাবি। কথিত আছে, তিনি নবিজির দাড়ি কাটতেন এবং তাঁর কিছু দাড়ির চুল নিজের কাছে সংরক্ষণ করেছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর কবরটি কাইরুয়ানে নির্মিত হয় এবং পরবর্তীতে সেখানে একটি মসজিদ গড়ে ওঠে—যা ‘মসজিদে সিদি সাহেব’ নামে পরিচিত।
এরপর যাত্রা এল জেম শহর। রবিবারের দুপুর, দ্রুত বেগে চলছে বাস। রাস্তা যেন জনশূন্য—দু’ধার বাংলাদেশের শস্যহীন ক্ষেতের মতো চাষহীন। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে অলিভের গাছগুলো। মাইলের পর মাইল গিয়ে চোখে পড়ে বাংলাদেশের গ্রামের বাজারের মতো বাজার। দোকানগুলোতে ক্রেতাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এমনিতেই খাবার খুব একটা আকর্ষণীয় নয়, তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের খাবারগুলো স্বাভাবিকভাবেই হালাল। আমাদের ঐতিহ্যময় ভাত না থাকলেও ভাত ছিল হোটেলে। অনেক অনেক চয়েজের মাঝে ভাজা মাছও থাকে, আছে মোরগ কিংবা মাংস। সবকিছু ইনক্লুডিং হিসেবে হোটেলের ব্রেকফাস্টটি আমাকে প্রতিদিন টানতো—ভালোই ছিল, আমাদের মতোই। তাই সাতদিনের এই সফর যাতে অন্তত স্বাস্থ্যগতভাবে সমস্যাহীন থাকে, সেই সতর্কতায়ই লাঞ্চের জন্য ভালো রেস্তোরাঁর সামনে বাস নিয়ে যান গাইড ইমাদ। আমরা যে হোটেলে থাকি এবং খাবার খাই; সেই মানের হলেও চয়েজ ছিল অল্প। চড়া মূল্য (ব্রিটেনের হিসেবে স্বাভাবিক মূল্য) দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিলাম। তারপর বাস ছুটে চলে আবারও ইতিহাসের এক অসাধারণ সাক্ষী—তিউনিসিয়ার কলোসিয়ামের বিশাল বিল্ডিংয়ের নিদর্শন দেখতে। বিশাল অ্যান্টিক বিল্ডিং ঘেঁষে তৈরি হওয়া বাজারে বাস দাঁড় করান চালক করিম।
আরও পড়ুন
মধ্যাহ্ন এতটাই তীব্র তপ্ত যে, মিনিবাস থেকে নেমে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শরীর ভিজে ওঠে। ঠান্ডা পানীয়, আইসক্রিম, এমনকি লাঞ্চ সেরে নেওয়ার জন্য দোকানিদের ডাকাডাকি তো আছেই। এরই মধ্যে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে আমরা ঢুকি ওই বিল্ডিংয়ে।
কলোসিয়ামটি রোমান স্থাপত্যের একটি চমৎকার উদাহরণ, যা প্রাচীনকালে গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত হতো। এর বিশালতা এবং নির্মাণশৈলী সত্যিই অবাক করার মতো। ঐতিহাসিক কলোসিয়ামটি হচ্ছে এল জেম কলোসিয়াম। এটি একটি বিশাল রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার। এটি নির্মিত হয়েছিল তৃতীয় শতাব্দীতে (প্রায় ২৩৮ খ্রিষ্টাব্দে)। এতে প্রায় ৩৫ হাজার দর্শক ধারণের ক্ষমতা ছিল। এটি মূলত গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধ, জনসভা এবং অন্যান্য মনোরঞ্জনমূলক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হতো। বিশ্বের সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারগুলোর একটি হলো এই রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার।
এটি রোমান ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এতে ব্যবহার করা হয়েছিল বড় আকারের বেলে পাথর, যা আজও টিকে আছে। পুরো কাঠামোটি একটি উভচক্রাকার নকশায় তৈরি, ঠিক যেমন রোমের কলোসিয়াম। বাইরের দেওয়ালে আর্চ এবং কলামের সংমিশ্রণে তিনটি স্তরে সৌন্দর্য ও ভারসাম্য তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি স্তরে ভিন্ন ভিন্ন স্থাপত্যিক শৈলী—যেমন প্রথম স্তরে ডোরিক শৈলী, দ্বিতীয় স্তরে আইওনিক শৈলী এবং তৃতীয় স্তরে কোরিন্থিয়ান শৈলী।
এল জেম কলোসিয়ামের ছিল তিনটি প্রধান স্তর বা তলা। নিচে ছিল ভূগর্ভস্থ কক্ষ, যেখানে গ্ল্যাডিয়েটরদের রাখা হতো, বন্যপশুদের জন্য খাঁচা ছিল, মঞ্চের নিচে রোমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে লিফট ও দরজা ছিল—যা থেকে হঠাৎ করে গ্ল্যাডিয়েটর বা পশুদের বের করা হতো। আসনগুলো বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা ছিল—উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক পর্যন্ত। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এটি কিছুটা জীর্ণ মনে হলেও আজও অনেকাংশে অক্ষত এবং ঘুরে দেখার জন্য উন্মুক্ত। এটি এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। বহু পর্যটক এর স্থাপত্যশৈলী ও ইতিহাস জানতে এখানে ভ্রমণ করেন।
প্রচণ্ড গরমের এই মধ্যাহ্নে এই হেরিটেজ বিল্ডিংটি ঘুরে দেখা শেষে সামান্য পানীয় আর আইসক্রিম খেয়ে নিজেকে কিছুটা শীতল করে আমাদের যাত্রা সউস শহরের দিকে। সউসের ইতিহাস প্রায় ৩ হাজার বছর পুরোনো। এটি ফিনিশিয়ান, রোমান, বাইজেন্টাইন, আরব ও ফরাসি শাসনের অধীনে ছিল।
শহরটির পুরোনো অংশ বা মদিনা অব সউস একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, যা ১৯৮৮ সালে তালিকাভুক্ত হয়। গাইড আমাদের এখানেই নিয়ে যান। তিউনিসিয়ার প্রত্যেকটি মদিনা কিংবা পুরোনো শহরই তাদের ঐতিহ্য। যেখানেই গেছি, সেখানেই মনে হয়েছে ছোট ছোট গলির রাস্তা, পর্যটকরা হাঁটছে, দোকানিরা টানছে পর্যটকদের। সবাই-ই টুকটাক শপিং করতে থাকেন সবখানেই। তবে এখানকার ঐতিহ্যবাহী সুক বা বাজারগুলোতে তাদের লোকজ শিল্প ও কারুশিল্পের মূল্য দোকানিরা একটু বেশিই চান। দরাদরি পর্যটকরা প্রায়ই করে থাকেন এবং গাইড আগেই বলে দিয়েছেন, মিনিমাম ৫০ শতাংশ কম বলার জন্য। কিন্তু এখানকার দোকানিরা এতে তৃপ্ত নন। মাঝে মাঝে মুখ কালো করে উত্তর দেন, যদিও কাস্টমার তারা হারাতে চান না।
সউস তিউনিসিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় সমুদ্রতীরবর্তী পর্যটন শহরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখেছি অভিজাত বাড়িগুলো। গাইড বললেন, ধনীদের আবাস এই অঞ্চল। সমুদ্রসৈকতটি মনে হয়েছে হামামাতের চেয়েও জনপ্রিয়। তপ্ত রোদের সময়ে দেখলাম, অসংখ্য পর্যটক সমুদ্রস্নানের পাশাপাশি রোদ পোহাচ্ছেন। হামামাতের মতো এখানেও আছে চমৎকার সাদা বালুর সৈকত, রিসোর্ট, হোটেল ও নৌভ্রমণের সুযোগ। সউস একটি প্রধান বন্দর শহর এবং শিল্পাঞ্চল। এটি তিউনিসিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর এবং দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশেষত তেল, অলিভ অয়েল, টেক্সটাইল ও পর্যটন এই শহরের প্রধান আয়ের উৎস।
তিউনিসিয়ার সমুদ্র উপকূল পশ্চিমা পর্যটকদের জন্য অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় জায়গা, যার মাঝে সউস অন্যতম। আর তাই প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটককে টানে দেশটি। কিন্তু ২০১৫ সালের ২৬ জুন এরকমই এক তপ্ত দিনে এখানে ঘটে যায় এক নির্বিচার নৃশংস বন্দুক হামলা। সাইফেদ্দিন রেজগুই নামের ২৩ বছরের এক তিউনিসিয়ান যুবক অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ৩৮ জন পর্যটককে হত্যা করে। সউস শহরের উপকূলে অবস্থিত পোর্ট এল কান্তাউই-এর কাছে সন্ত্রাসী হামলাটি ছিল তিউনিসিয়ার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। সেসময় এই ভয়াবহ হামলার দায় স্বীকার করে আইএসআইএস। যদিও সন্ত্রাসীকে নিরাপত্তা বাহিনী সেসময়ই গুলি করে হত্যা করেছিল।
২০১৫ সালের সউস সন্ত্রাসী হামলা ছিল একটি বর্বর ও দুঃখজনক ঘটনা, যা শুধু তিউনিসিয়ার নয় বরং বিশ্বের পর্যটনশিল্পের নিরাপত্তা ও জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ের বাস্তবতা সামনে নিয়ে আসে। সেই বাস্তবতার কারণেই সেসময় থেকে তিউনিসিয়ার পর্যটন খাতে মারাত্মক ধাক্কা লাগে। পরবর্তীতে তিউনিসিয়া সরকার জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করে। সৈকত, হোটেল ও পর্যটন স্থানে বাড়ানো হয় পুলিশি টহল। বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্কার ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়। হয়তো সেই কারণেই যে জায়গায়ই গেছি; সেখানেই মনে হয়েছে নিরাপদ। মধ্যরাতেও মানুষকে হাঁটতে দেখেছি সমুদ্রসৈকতে। কোথাও কোনো বাঁকা চাহনি দেখিনি আমাদের এক সপ্তাহ সময়কালে। আমার তো মনে হয়েছে, এমনকি ব্রিটেনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার থেকেও যেন নিশ্ছিদ্র ছিল আমাদের সময়গুলো।
রোদের ঝাঁজ আর উষ্ণতা সাথে নিয়েই বিকেল ৭টার দিকে ফিরি আমাদের প্রাসাদোপম হোটেলে, যেখানে দীর্ঘসময় কাজ করেন, পরিশ্রম করেন অনেক তরুণ-তরুণী কিংবা আধাবয়সী মানুষ। যাদের মুখে মুখে লেগে থাকে সব সময় গ্রাহকদের সুখী রাখার এক উষ্ণ আহ্বান। এখান থেকেই শুরু হবে আগামীর সকালে ‘সিডি বৌ সাইদ’ নামের শহরের দিকে পরের যাত্রা।
এসইউ/এমএস